সুরহীন অনুভূতির গল্প

সুরহীন অনুভূতির গল্প

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

এক এমআরআই পরীক্ষার সময়, প্রকরণবিদ রোগীর মনের উদ্বেগ হালকা করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন ,“কোন ধরনের গান শুনতে চান?” সাধারণত মানুষ পরীক্ষার ভয় বা উদ্বেগ কাটাতে শান্ত কিংবা আনন্দদায়ক সুর বেছে নেন। কিন্তু রোগী বেছে নিলেন— সম্পূর্ণ নীরবতা। আসলে এটিই তাঁর দৈনন্দিন বাস্তবতা। তিনি এক বিশেষ স্নায়ুবৈজ্ঞানিক অবস্থার শিকার। যার নাম মিউজিকাল অ্যানহেডোনিয়া বা সংগীত -অসাড়তা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মিউজিকাল অ্যানহেডোনিয়া এমন এক অবস্থা যেখানে মস্তিষ্ক সংগীতকে ‘অনুভূতি’ হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যর্থ। অন্যদের যেখানে সুরের ওঠানামায় আনন্দানুভূতি বা আবেগে চোখ ভিজে ওঠে, সেখানে এদের কাছে অধিকাংশ গান নিছক শব্দ মাত্র। এই গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, তাঁর মস্তিষ্কের প্রাপ্তিযোগ সিস্টেম (ডোপামিন নির্ভর স্নায়ুপথ) এবং সংগীত প্রক্রিয়াজাতকরণের অংশগুলির মধ্যে কার্যকর সংযোগ নেই। তবুও সংগীত তাঁর জীবন থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি। বিশেষ করে গানের কথা তাঁকে টানে। দীর্ঘ লেখকজীবনে শব্দই ছিল তাঁর প্রধান সহচর। তাই যখন কোনো গানের কথায় মানব-অভিজ্ঞতার গভীরতা, নিখাদ আবেগ কিংবা কবিতার মতো সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, তখন সেটিই তাঁর কাছে হয়ে ওঠে প্রিয় গান। তবে কৃত্রিম ছন্দ, জোর করে বসানো মিল কিংবা দুর্বল রূপক তিনি সহজেই প্রত্যাখ্যান করেন।
তবে তার জীবনে সংগীতের উপস্থিতি আগাগোড়াই ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে গাড়িতে বেড়ানো, স্কুলের নৃত্যানুষ্ঠান কিংবা কলেজ জীবনের নাইট ক্লাব- সর্বত্রই গান জড়িয়ে ছিল। ফলে কিছু গান, তাঁর স্মৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। ব্রায়ান অ্যাডামসের একটি গান শুনলেই তিনি ফিরে যান ৩৩ বছর আগের প্রথম নাচের স্মৃতিতে। আজও সেই গান বাজলে পুরোনো বন্ধুকে তিনি একটি বার্তা পাঠিয়ে দেন। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, সংগীত মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস ও অ্যামিগডালাকে সক্রিয় করে অতীত স্মৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। যদিও তিনি বেশিরভাগ বাজনা পছন্দ করেন না তবে এক্ষেত্রেও কিছু ব্যতিক্রম আছে। গ্লেন মিলারের কিছু সৃষ্টি তাঁর কাছে কেবল সংগীত নয়—ঠাকুরদা ঠাকুমার রেডিওতে বাজানো এই সুরের সঙ্গে মিশে আছে তার শৈশবের উষ্ণতা। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন, পরিচিত সুর মস্তিষ্কে ‘পরিচিতি প্রভাব’ তৈরি করে, যা নিরাপত্তা ও স্বস্তির অনুভূতি জাগায়। তালের প্রভাব তিনি স্পষ্টই টের পান। জিমে ব্যায়াম করার সময় বা ঘর পরিষ্কারের মুহূর্তে কোনো দ্রুত তাল তাঁকে বাড়তি শক্তি দেয়। বিজ্ঞান এ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে ‘রিদম-ইনডিউসড মোটর এনার্জি’ (ছন্দ উৎসারিত চলন শক্তি ) হিসেবে। সেখানে সংগীতের ছন্দ শরীরের গতিকে ত্বরান্বিত করে। শৈশবে সংগীতের প্রতি অনাগ্রহকে তিনি গোপন রেখেছিলেন। তখন এর কোনো নাম ছিল না। আজ স্নায়বিক বিবিধতার ধারণা সমাজে ক্রমশ স্বীকৃতি পাচ্ছে। অটিজম বর্ণালী থেকে শুরু করে এডিএইচডি বা সঙ্গীত-অসাড়তাকেও সেই বৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাঁর কাছে সঙ্গীত হয়তো আনন্দের উৎস নয়, কিন্তু তা স্মৃতি, শব্দ, তাল ও আবেগের নানা উপায়ে তাঁকে ছুঁয়ে যায়। বিজ্ঞান দেখিয়েছে, মানুষের মস্তিষ্কে আবেগ অনুভবের হাজারো রূপ আছে। তাঁর কাহিনী শুধু সেই বৈচিত্র্যের আরেকটি প্রমাণ।

সূত্র : Understanding individual differences to specific rewards through music by
Ernest Mas-Herrero, et.al ; Trends in Cognitive Science (November , 2024)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 + thirteen =