
প্রতি বছর পূর্ব আফ্রিকার তৃণভূমিতে লক্ষ লক্ষ বন্য ষাঁড় বা গনু ছুটে চলে সেরেঙ্গেটি ও মাসাইমারা জুড়ে। দীর্ঘদিন ধরে বলা হতো এটি বিশ্বের বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম অভিবাসন। প্রচলিত ধারণা ছিল, প্রায় ১৩ লক্ষ গনু এই অভিবাসনে অংশ নেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। এই সংখ্যা আসলে অর্ধেকেরও কম। নতুন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অংশগ্রহণকারী গনুর সংখ্যা ৬ লক্ষেরও নীচে। তাহলে কোথায় হারিয়ে গেল বাকিরা? আসলে এর আগে বিজ্ঞানীরা আকাশপথে, নির্দিষ্ট রেখা ধরে ছবি তুলে এবং গণিতের মডেল ব্যবহার করে এই সংখ্যা অনুমান করতেন। কিন্তু এ পদ্ধতিতে অনেক সময় একই দলকে একাধিকবার গোনা হতো, আবার অনেক দল একেবারেই বাদ পড়ত। এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে গবেষকরা এবার ভরসা করেছেন উপগ্রহের উপর। উচ্চ-রেজোলিউশনের উপগ্রহ ছবি একসঙ্গে কয়েক লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকার ছবি তুলতে পারে, আর প্রাণীদেরও বিরক্ত করে না। সমস্যা হলো, এই ছবির ভিতর বিপুল সংখ্যক গণুকে হাতে গোনা প্রায় অসম্ভব। তাই কাজে লাগানো হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা কৃ বু-কে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা U-Net ও YOLOv8 নামে দুটি ডিপ-লার্নিং মডেলকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। গনুর ক্ষুদ্রাকৃতির সিলুয়েট মাত্র ৬ থেকে ১২ পিক্সেল চওড়া। এদের চিনতে মডেলগুলোকে ৭০ হাজার চিহ্নিত উদাহরণের ওপর প্রশিক্ষিত করা হয়। পরীক্ষায় মডেলগুলোর অভ্রান্ততা সূচক ০.৮৩ পর্যন্ত পৌঁছায়। যা এ ধরনের গবেষণায় উৎকৃষ্ট মান ধরা হয়। ২০২২ ও ২০২৩ সালের আগস্টে কেনিয়া ও তানজানিয়ার মাসাইমারা অঞ্চলের উপগ্রহ ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, ২০২২ সালে এই গনুর সংখ্যা ৩,২৪,২০২ থেকে ৩,৩৭,৯২৬ এর মধ্যে ছিল। ২০২৩ সালে ৫,০২,৯১৭ থেকে ৫,৩৩,১৩৭ এর মধ্যে । অর্থাৎ, ১৯৭০-এর দশক থেকে প্রচলিত ১৩ লক্ষের অনুমানের তুলনায় অনেক কম।
গবেষণার নেতৃত্ব দেন অক্সফোর্ডের ড. আইলা ডুপোর্জ। তাঁর মতে, “আমাদের তথ্যর সঙ্গে প্রচলিত ধারণার এতটা অমিল যে প্রশ্ন জাগে, হারিয়ে যাওয়া গনুগুলো কোথায় গেল?” বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, অধিকাংশ গনুই সমীক্ষার আওতায় ছিল। কিছু হয়তো গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কয়েক লক্ষ প্রাণী একসঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্ভাবনা আছে, জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টির ধরন বদলে যাওয়ায় চারণভূমি পাল্টে যাওয়ার। আবার কৃষি, সড়ক ও বেড়া তৈরি হওয়ায় চিরাচরিত পথও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দল ভাগ হয়ে যেতে পারে বা যাত্রাপথ পাল্টে ফেলতে পারে। অন্যদিকে, উপগ্রহ ছবি থেকে গনু ও অনুরূপ প্রাণী (যেমন জেব্রা) আলাদা করা সবসময় সহজ নয়। তাই অনুমান কিছুটা হেরফের হতে পারে। গনুর এই মহা অভিবাসন শুধু দৃশ্যের নয়, পরিবেশব্যবস্থারও প্রাণরস। সিংহ, কুমির, হায়েনা থেকে শুরু করে অসংখ্য শিকারী এই অভিবাসনের ওপর নির্ভর করে। তাছাড়া কেনিয়া ও তানজানিয়ার পর্যটন অর্থনীতিতেও এর বিশাল প্রভাব রয়েছে। যদি সত্যিই বুনো ষাঁড় দের সংখ্যা কমে যায়, তবে এর প্রভাব পড়বে গোটা বাস্তুতন্ত্রে। তাই নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া একান্ত জরুরি। গবেষক দল মনে করছে, উপগ্রহ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগল প্রয়োগ ভবিষ্যতে শুধু বুনো ষাঁড় নয়, হরিণ, উট, রেইনডিয়ার কিংবা আফ্রিকান গন্ডার—সবকিছুর পর্যবেক্ষণে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ডেভিড ম্যাকডোনাল্ডের ভাষায়, “যে কোনো প্রজাতি সংরক্ষণের মূল ভিত্তি হল, তাদের সঠিক সংখ্যা জানা। উপগ্রহ ও কৃ বু নির্ভর এই প্রযুক্তি বুনো ষাঁড়ের সংখ্যা গণনায় বিপ্লব এনেছে এবং আরও বহু প্রজাতি পর্যবেক্ষণের পথ খুলে দিয়েছে।” তবে আপাতত বড় প্রশ্ন, আমাদের অনুমিত সেই লক্ষ লক্ষ গনু আসলেই কি নেই, নাকি তারা আমাদের চোখ এড়িয়ে অন্য পথে অন্যত্র চলে গেছে?
সূত্র : AI-based satellite survey offers independent assessment of migratory wildebeest numbers in the Serengeti by Isla Duporg, PNAS Nexus, Volume 4, Issue 9, September 2025, pgaf264,