হাড়গিলা সংরক্ষণে ‘আ র ণ্য ক ‘

হাড়গিলা সংরক্ষণে ‘আ র ণ্য ক ‘

সৌমিত্র চৌধুরী
পূর্বতন বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থা, কলকাতা
Posted on ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

অদ্ভুত ধরনের পাখি। ঢাউস আকার। নাম হাড়গিলা। ইংরাজিতে গ্রেটার অ্যাডজুটেন্ট স্টর্ক। সারস বক এরকম অনেক পাখিই স্টর্ক গোত্রের। কিন্তু হাড়গিলাকে অ্যাডজুটেন্ট বলে কেন?
কারণ এদের চালচলন। অ্যাডজুটেন্ট মানে একধরণের একবগ্গা মিলটারি অফিসার। উপর‍ওয়ালার নির্দেশের অপেক্ষায় সেই সামরিক অফিসাররা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। হেলে দুলে চলে আর ঘাড় ঘুরিয়ে চোখা চাহনি হানে। পাখিগুলোর রকম সকমও ঠিক এরকম।
সামরিক উর্দি পরা ব্রিটিশ সৈনিকরা স্টর্কদের চালচলন দেখে ওদের নাম দিয়েছিল, ইন্ডিয়ান অ্যাডজুট্যান্ট।অনেকে অ্যাডজুট্যান্টও বলে। জীব বিজ্ঞানের পরিভাষায়, লেপটোপটিলোস ডুবিয়াস (Leptoptilos dubius)। বাংলা,আসামিয়া ভাষাতে হাড়গিলা। শব্দের উৎপত্তি নাকি অসমিয়া ভাষা থেকেই। বাংলার মতোই মানে। হাড় আর তাকে গিলে ফেলতে পারে, তাই পাখির নাম হাড়গিলা।
একশ বছর আগেও দেশের বহু জায়গায় এই পাখিদের দেখা মিলত। কলকাতার উঁচু বাড়ির ছাদে, বড় গাছের ডালে হাড়গিলার পাখির দল বাসা বানাতো। দুশো বছর আগে কলকাতার ময়দানে গাছের উপর ঝাঁক বেঁধে বসে থাকতো হাড়গিলা। পাখিগুলো নোংরা আবর্জনা খেয়ে শহর পরিষ্কার রাখতো। ঝাড়ুদার পাখি তো! সমাজের উপকারী। উপকারের প্রতীক হিসাবে তার ছবি আঁকা থাকতো কলকাতা পুরসভার প্যাডে। ‘কোট অফ আর্মস’সেই প্রতীকের নাম।
উপকারী পাখির গুণের কদর পুরসভাবুঝতে পেরেছিল। হাড়গিলা হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।কলকাতা পৌর সংস্থার লোগো বা প্রতীকটি-তে দুটি Greater Adjuntant Stork আছে। এছাড়াও জেমস বেলি ফ্রেজার – 1826 (সূত্র ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ইউকে) দ্বারা অংকিত চিত্রে কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসের দক্ষিণ-পূর্ব গেটওয়ের কাছ থেকে কোর্ট হাউস স্ট্রিট দৃশ্যে অনেকগুলি বড়ো অ্যাডজুট্যান্টকে একসাথে উড়তে দেখা যায়। কিন্তু শহরের মানুষ এই পাখি পছন্দ করতো না। পাখিটা মরা জীবজন্তু খায়। তাই মনে করতো হাড়গিলা নোংরা অপবিত্র পাখি। সুযোগ পেলেই মেরে ফেলতো হাড়গিলা পাখি।তবে পাখি হত্যার অন্য কারণও ছিল। পাখির পালকের সে সময় অনেক দাম। চোরা গোপ্তা বিক্রি হত। ইংল্যান্ড ফ্রান্সেও চলে যেত পাখির পালক। মেম সাহেবদের পোষাকের শোভা বাড়াত পাখির পালক।
কিন্তু দুঃখের কথা কলকাতা কিংবা পশ্চিমবাংলায় পাখিটাকে ইদানীং দেখা যায় না। হাড়গিলা কি ডোডো পাখির মত বিলুপ্ত হয়ে গেল? কোনো দিন আর এদের দেখা যাবে না পৃথিবীতে?

অনেকেই ভাবতো হাড়গিলা পৃথিবী থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ডোডা কিংবা রেন পাখির মত অবলুপ্ত। পাঁচ-ছয় বছর আগে গোটা পৃথিবীতে টিকে ছিল মাত্র হাজার খানেক হাড়গিলা। মাত্র এক হাজার।সুন্দরবনের একটা গাছেই তো হাজার খানেক টিয়াপাখি থাকে।
দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছিল হাড়গিলা। মানে পৃথিবীর বুক থেকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। কিন্তু অল্প কিছু মানুষের চেষ্টায় বিলুপ্তির মুখ থেকে ফিরে আসছে হাড়গিলা। পাঁচ বছর আগেও আসামে টিকে ছিল কয়েকশো পাখি। আর এখন সেখানে পাখির সংখ্যা কয়েক হাজার। কেমন করে এতটা বাড়ল?
কয়েকজন মানুষের চিকিৎসা যত্ন পেয়ে পাখি গুলো মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এল। ‘আরণ্যক’ নামের এক সংস্থা আসামের কয়েকটি জায়গায় সংরক্ষণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আসলে জঙ্গলের সংরক্ষিত অঞ্চলে অনেক উঁচু উঁচু গাছ আছে। সেখানে অনেক ধরনের পাখিই বাসা বাঁধে। কিন্তু হাড়গিলা তো জংলী পাখি নয়। জঙ্গল ওরা ভালবাসে না। ওদের পছন্দ মানুষের বসতি অঞ্চল। সেখানে জীবজন্তুর মৃতদেহপাওয়া যায়।
মৃত পশুপাখি খায়, দেখতেও ‘খারাপ’ তাই মানুষ হাড়গিলা পাখি পছন্দ করে না। আসামের গ্রাম দেশেও লোকজন হাড়গিলা পছন্দ করতনা। শহর থেকে অনেক দূরে দাদরা, সিঙ্গিমারি গ্রাম গুলোতে গাছের ডালে বাসা বাঁধতো হাড়গিলা। ঝড়ে বাসা ভেঙে মাটিতে পড়ে মারা যেত পাখিগুলো। কিন্তু ‘আরণ্যক’ সংস্থার উদ্যোক্তারা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বুঝিয়ে বলতো,‘তোমরা পাখিগুলো বাঁচাও। একটু যত্ন পেলে বেঁচে যাবে। নইলে পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না পাখিগুলো।’
গ্রামের লোকেরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, বিলুপ্তপ্রায় পাখি গুলোকে বাঁচানো দরকার। জীবজন্তু গাছপালা মানুষ নিয়েই তো বাস্তুতন্ত্র। এর একটা জায়গায় আঘাত লাগলে পুরটাই ভেঙে যায়। একটা প্রজাতি ধ্বংস হয়ে গেলে মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন।
ওই গ্রামের মানুষজন পাখি সংরক্ষণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিজেদের বাড়ির কদম গাছের মগ ডালে এখন পাখিগুলোকে বাসা বাঁধতে দিচ্ছে। গাছ থেকে বাচ্চাপাখি পড়ে গেলেও সেবাযত্ন চিকিৎসা করে ওদের সুস্থ্ করে তুলছে। গ্রামের তাঁতিরা সুতো দিয়ে ওই পাখিদের ছবি ফোটাচ্ছে চাদর বা গামছায়। বিলুপ্তির মুখে দাঁড়ানো পাখি সংরক্ষণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেকয়েকটা গ্রামের সাধারণ মানুষ।

প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার কাজে ওই গ্রামের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেছে ‘আরণ্যক’। আর এই সংস্থাটি তৈরির প্রধান উদ্যোক্তা, ডক্টর পূর্ণিমাদেবী বর্মণ। তাঁর নেতৃত্বে দাদরা এবং সংলগ্ন সিঙ্গিমারি, পাসারিয়াগ্রামে মহিলারা তৈরি করেছে‘হাড়গিলা ব্রিগেড’। এই‘হাড়গিলা বাহিনী’র সঙ্কল্প,প্রকৃতির বুক থেকে হাড়গিলা পাখিকে নিশ্চিহ্ন হতে দেবোনা।
প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজে আসামের সংস্থা‘আরন্যক’ আর হাড়গিলা বাহিনীর অবদান ইতিহাস স্মরণে রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × 1 =