
আবলুস গাছ। এর কুচ কুচে কালো কাঠ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হয়ে উঠেছে বাজনা তৈরির অপরিহার্য উপাদান। অথচ এর প্রজনন আজও রহস্যময়। ক্যামেরুনে গিটার নির্মাতা বব টেইলর একটি আবলুস করাতকল কিনেছিলেন, গাছ লাগানোর উদ্দেশ্যে। প্রায় একই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানী টমাস স্মিথ গবেষণা করছিলেন, কীভাবে প্রাণীরা ক্রান্তীয় বর্ষাবনে নতুন গাছ জন্মাতে সাহায্য করে। দুই দিকের দুই উদ্যোগ একত্রে জন্ম দিল আবলুস রক্ষা প্রকল্প – ‘দ্য ইবনি প্রজেক্ট’- এর। এ এক অনন্য সহযোগিতা। একদিকে বাকা আদিবাসী অন্যদিকে স্থানীয় বান্তু সম্প্রদায়। লক্ষ্য শুধু গাছ লাগানো নয়, আবলুসের অদৃশ্য জীবচক্রকে বোঝা। শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল এক বিস্ময়কর সহায়ককে। আফ্রিকান বুনো হাতি। এই হাতিরা আবলুস ফল খায়, বীজকে দূরে নিয়ে যায়, মলমূত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। হাতির মল শুধু বাহকই নয়, রক্ষাকবচও বটে। এর মধ্যে বীজ ইঁদুর বা অন্যান্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকে। দেখা গেছে যেখানে হাতি নেই, সেখানে আবলুস চারা গাছ ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত কম জন্মায়। টমাস স্মিথের কথায়, “মানুষ ভাবে হাতি হারালে শুধু একটা প্রজাতি হারিয়ে যাবে। কিন্তু আসলে হারাবে তার পরিবেশগত ভূমিকা। আর তার সাথে হারাবে বনজ প্রজাতির ভবিষ্যৎ।” হাতি-শূন্য অরণ্যে দেখা যায়, নতুন চারাগুলি ঘন মন্ডলে মূল গাছের পাশে জন্মায়, দূরে ছড়াতে পারে না। এর ফলে ঘটে জিন বৈচিত্র্যের ক্ষতি, যা রোগ বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রজাতিকে দুর্বল করে তোলে। দীর্ঘ দূরত্বে বীজ ছড়ানো মানেই বিভিন্ন জিনের মিশ্রণ। কিন্তু হাতি না থাকলে সেই গতিশীলতা ভেঙে পড়ে। বিজ্ঞানীরা ক্লাসিক জানসেন-কনেল হাইপোথিসিস অনুযায়ী পরীক্ষা করেন, মাতৃগাছ থেকে দূরে জন্মালে চারার টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি হয় নাকি কম? আশ্চর্যের ব্যাপার, তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং প্রমাণ মিলল হাতির মলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার। মাটিতে বা ফলের ভেতরে থাকা বীজ ইঁদুর দ্রুত খেয়ে ফেলে, কিন্তু মলে থাকা বীজ খাওয়ায় সম্ভাবনা আট গুণ কম। ফলে সেগুলি তিন গুণ বেশি অঙ্কুরিত হয়। অন্যদিকে যেখানে শিকার বেশি, সেখানে হাতি প্রায় বিলুপ্ত। ফলে ইঁদুর প্রজাতি আধিপত্য বিস্তার করে, বীজ জমা রাখে মাটির গভীরে, কিন্তু সেখান থেকে আর চারাগাছ জন্মায় না। এর ফলে নতুন প্রজন্মের আবলুস গাছ কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে। ইতিমধ্যেই আবলুস তার ঐতিহাসিক বিস্তৃতির দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে হ্রাসপ্রাপ্ত। বাকা প্রবীণরা কিন্তু বহু আগেই লক্ষ্য করেছিলেন, হাতির মলে আবলুস চারা জন্মায়। সেই প্রজন্মগত জ্ঞানই বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে দিক দেখাচ্ছে। এভাবেই প্রকল্পটি কেবল গবেষণাই নয়, স্থানীয় জ্ঞানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদাহরণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পটি এখন স্থানীয় সম্প্রদায়কে ফলের গাছ, প্রশিক্ষণ ও নার্সারি সরবরাহ করছে, যাতে মানুষ ও বন দু’পক্ষই লাভবান হয়। বব টেইলর নিজেই বলেছেন, “আমি জীবনভর গিটার বানিয়েছি, কিন্তু দ্য এবনি প্রজেক্ট আমার জীবনের সবচেয়ে পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা। এটা মনে করিয়ে দেয়, কখনো কখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অন্যদের ভবিষ্যতের জন্য বীজ বপন করা।”এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি ৪০ হাজার আবলুস ও ২০ হাজার ফলের গাছ লাগিয়েছে। কিন্তু গবেষণা সতর্ক করছে, শুধু রোপণই যথেষ্ট নয়, যদি প্রাকৃতিক বীজ-বাহক হাতিকে রক্ষা না করা যায়।আবলুস ও হাতির এই সম্পর্ক আমাদের শেখায় যে সংরক্ষণ মানে শুধু একটি প্রজাতিকে নয়, বরং সম্পর্কের জালকে বাঁচিয়ে রাখা। একটি গাছের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এক দৈত্যাকার প্রাণীর অস্তিত্বের ওপর।
সূত্র : Declines of ebony and ivory are inextricably linked in an African rainforest by Vincent Deblauwe, et.al ; Science Advances (27 Aug 2025
Vol 11, Issue 35)