হারানো পূর্বজদের সন্ধানে

হারানো পূর্বজদের সন্ধানে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৪ মে, ২০২৫

এলেম আমি কোথা থেকে – যুগ যুগ ধরে এই প্রশ্ন মানুষকে ভাবিয়েছে। এ প্রশ্নের প্রধান স্বীকৃত উত্তর হল, আমরা একটাই বংশধারা থেকে উৎপন্ন। কিন্তু জিনতাত্ত্বিক সাক্ষ্য এখন এ তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। জানিয়েছেন কেম্ব্রিজের জিনতত্ত্ব বিভাগের গবেষক ডঃ ট্রেভর কাজিন্স। তাঁর দলের সহ-গবেষক প্রফেসর রিচার্ড ডারবিন লক্ষ্য করেছেন প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলি দশ লক্ষ বছরেরও বেশি সময় পরস্পরের থেকে আলাদা থাকার পর মিলিত হয়। সেই মিলনেরই ছাপ পড়েছে আধুনিক মানুষের জিনভিত্তিতে। তার মানে, একটা সরল রেখা ধরে এই বংশধারা বিবর্তিত হয়নি, হয়েছে জটিল আন্তঃক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

মানুষ আর নিয়ান্ডারথালরা সহাবস্থান করত শুধু নয়, মেলামেশা করত, রেষারেষি করত, এমনকি সন্তানও উৎপাদন করত। অন্তত পাঁচ থেকে দশ হাজার বছর এরা পরস্পরের সঙ্গে সহাবস্থান করেছিল। পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে, তারা একই ভূ-অঞ্চল, গুহা এমনকি হয়তো জ্ঞানও ভাগাভাগি করে নিত। নিয়ান্ডারথালরা হাতযন্ত্র বানাত, আগুন ব্যবহার করত, এমনকি মৃতদের সমাধি দেওয়ার মতো প্রতীকী আচরণ করত। আদি মানবের সঙ্গে তাদের কিছু কিছু কৃষ্টিগত মিল খুবই চমকপ্রদ। যা থেকে পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ার কথা মনে হয়। যেমন ব্যবসাবাণিজ্যর লেনদেন, এমনকি ভাবনাচিন্তার আদানপ্রদান।

কিন্তু এই নতুন গবেষণা বলছে, এরও প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে এদের মধ্যে আরও তাৎপর্যপূর্ণ জিন-মিশ্রণ ঘটেছিল। আজকের মানবদেহে যত জিন আছে তার ২০%-এ এই প্রাচীনতর মিশ্রণের চিহ্ণ রয়ে গেছে। তুলনায় নিয়ান্ডারথাল ডি এন এ-তে ছিল আফ্রিকা-বহির্ভূত আধুনিক মানুষের মাত্র ২% জিন। প্রাচীন জীবাশ্মর বদলে এই গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক মানব-ডি এন এ। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জনসমষ্টি থেকে জিন নমুনা নিয়ে এঁরা গবেষণা করেছেন। তা থেকে এমন প্রাচীন প্রজন্মের প্রমাণ মিলেছে, জীবাশ্মে যার প্রত্যক্ষ চিহ্ণ মেলে না। ‘কব্‌রা’ নামে এক অত্যাধুনিক কম্পিউটার-নির্মিত হাতিয়ার ব্যবহার করে এঁরা একটা মডেল তৈরি করে দেখিয়েছেন কী করে জনগোষ্ঠীগুলো আলাদা হয়ে গিয়ে আবার পুনর্মিলিত হয়েছিল। প্রথমে তাঁরা সিমুলেট করা উপাত্তর (ডেটা) উপর অ্যলগোরিদ্‌মটিকে প্রয়োগ করে দেখেন। তারপর সেটিকে বাস্তবে মানবজিনোমের পর্যায়ক্রম নিরূপণের কাজে লাগান। দেখা গেল, পূর্বজ দুই জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তাদের একটি গোষ্ঠী কোনো একটা ঝামেলায় পড়ে। ফলে দশ লক্ষ বছরের একটি পর্বে তাদের লোকসংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসে। এই ছোটো গোষ্ঠীটিই পরে আধুনিক মানুষের দেহে প্রাপ্ত জিনগুলি সঞ্চার করে। এরাই হল সেই পূর্বজ জনগোষ্ঠী যা থেকে নিয়ান্ডারথালরা আর ৩৭০০০০ বছর আগে ইউরেশিয়াতে উদ্ভূত ডেনিসোভানরা বিবর্তিত হয়। এদিকে দ্বিতীয় গোষ্ঠীটির দেহে মস্তিষ্কচালনা আর স্নায়ু-প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিনগুলি হাজির ছিল। আধুনিক মানুষের দেহের জিনসমষ্টিতে এদের অবদান অপেক্ষাকৃত কম হলেও এইগুলিই হয়তো মানুষের বিবর্তনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব জিনঘটিত লক্ষণের অভিযোজনক্ষমতা কম, প্রাকৃতিক নির্বাচন ক্রমে ক্রমে সেইসব জিনঘটিত লক্ষণকে ছেঁকে বার করে দিয়েছে। ক্ষতিকারক পরিব্যক্তিগুলি বাতিল হয়ে গিয়ে জিনের উপকারী রূপগুলি এইভাবে টিকে গেল। এই প্রক্রিয়াটিকে বলে ‘নির্বাচনী শুদ্ধতা’। তবে মানুষের এইসব পূর্বপ্রজন্মের পরিচয় এখনো অজ্ঞাত। ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রচুর গবেষণার সুযোগ রয়েছে। এ গবেষণার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার জেনেটিক্স’ পত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × one =