হারানো স্মৃতি ও ভাঁজ-হারানো প্রোটিন

হারানো স্মৃতি ও ভাঁজ-হারানো প্রোটিন

সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
সদস্য, সম্পাদকীয় বিভাগ, বিজ্ঞানভাষ
Posted on ৩ আগষ্ট, ২০২৫

আলঝেইমার্স মানেই কি স্নায়ুক্ষয় জনিত রোগ? গবেষণা বলছে, এমন অনেক বোধবৌদ্ধিক অবক্ষয় আছে যার অন্তরালে সরাসরি কোনো স্নায়ুক্ষয় জনিত রোগ থাকে না। অর্থাৎ, স্নায়ুকোষ মরেনি, মগজে ফাঁকাও পড়েনি, তবু স্মৃতি ধোঁয়াটে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী স্টিফেন ফ্রিড ও তাঁর দল অসাধারণ এক গবেষণায় বের করেছেন, আমাদের মগজের এই স্মৃতিহীনতা কেবল অ্যামিলয়েড বিটা (Aβ) আর টাউ (tau)- এই দুটি ‘দুষ্টু প্রোটিন’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সমস্যার শিকড় আরও গভীরে। আসল গোলমাল হচ্ছে প্রোটিনের ভাঁজে। মাথার ভেতরে হাজারো প্রোটিন থাকে যাদের সঠিকভাবে কাজ করতে হলে নির্দিষ্ট ভাঁজ বা গঠন থাকতে হয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাঁজে হালকা পরিবর্তন আসে। মগজের কাজকে এলোমেলো করে দেয় এই অদৃশ্য বদল। ফ্রিডের দল এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুই বছর বয়সী ইঁদুরদের মস্তিষ্কে কী ঘটে তা দেখেন। বয়সের তুল্যতার হিসেবে এই ইঁদুররা ৭০ বছর বয়সী মানুষের কাছাকাছি। তাঁরা ১৭টি ইঁদুরের স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করে দেখেন। ৭টির মস্তিষ্ক দুর্বল, ১০টির তাজা। সেই তুলনার ভিত্তিতে হিপোক্যাম্পাসে (স্মৃতি প্রক্রিয়া অঞ্চলে) ২,৫০০+ প্রোটিনের মধ্যে ২০০টির গঠনে তফাৎ ধরা পড়ে। তাঁরা এই প্রোটিনগুলির বদলে যাওয়ার নাম দিয়েছেন বোধবুদ্ধি-সম্পর্কিত কাঠামো-বদল (Cognition-Associated Structural Changes)। এগুলি মস্তিষ্কের সেইসব শারীরিক পরিবর্তন যারা আমাদের চিন্তা, শেখা, স্মরণশক্তি বা উপলব্ধি করার ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। এইসব পরিবর্তন বয়স বৃদ্ধির কারণে বা কোনো রোগের প্রভাবে হতে পারে এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রোটিনগুলি কোনো অণুবীক্ষণে ধরা পড়ে না। এরা জমাট বাঁধে না, তন্তু (ফাইবার) তৈরি করে না। কিন্তু এদের গঠন এমনভাবে বদলে যায় যে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতায় হঠাৎ পরিবর্তন আসে। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হল, এই প্রোটিনগুলো একবার ভাঁজ খোলার পর আর নিজের পুরনো ভাঁজে ফেরে না (নন-রিফোল্ডেবল)। ফলে তারা নষ্ট হয়ে গেলেও শরীর সেটা বুঝতে পারে না, মুছেও ফেলতে পারে না। ফ্রিড বলছেন, এখন বোঝা যাচ্ছে, মাথার ভেতরে এক গোপন যুদ্ধ চলছিল বহুদিন ধরে। একটা পুরো ‘প্রোটিন ভাঁজ-খাওয়া কর্মজাল’ আছে – তার নাম প্রোটিওস্ট্যাসিস নেটওয়ার্ক। সেখানে ক্যাপারন প্রোটিন, গুণমান নিয়ন্ত্রণ এবং বিনষ্টকরণ প্রক্রিয়ার উপাদানসমূহ থাকে। কিন্তু বয়স বাড়লে এই ব্যবস্থাগুলো দুর্বল হয়ে গেলেই সুযোগ পেয়ে যায় এই “ভাঁজ-হারা” প্রোটিনেরা। তাঁরা দেখলেন, সব ইঁদুরেরই বয়স এক, কিন্তু যারা স্মৃতিশক্তিতে পোক্ত, তাদের মস্তিষ্কে এই গঠন-ভ্রষ্ট প্রোটিন প্রায় নেই। বরং তারা এমন জিনগত ও বর্তনী বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছিল যা সাধারণত তরুণ ইঁদুরদেরই থাকে। এই তুলনা থেকেই তাঁরা বুঝলেন, শুধু বয়স নয়, স্মৃতি হারানোর পেছনে আছে গঠনগত প্রোটিন বিপর্যয়। সুতরাং অ্যালঝেইমার-এর চিকিৎসার জন্য একই ধাঁচ অনুসরণ না করে নতুন ধরনের থেরাপি তৈরির দরজা খুলছে।

সূত্র : Proteins with cognition-associated structural changes in a rat model of aging exhibit reduced refolding capacity by Haley E. Tarbox et.al ; Science Advances(11July, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 − seven =