২০০ বছরের প্রাচীন শিকারী সিংহের ইতিবৃত্ত

২০০ বছরের প্রাচীন শিকারী সিংহের ইতিবৃত্ত

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৬ অক্টোবর, ২০২৪

১৮৯৮ সালে কেনিয়ার সাভো অঞ্চলে এই ঘটনার সূত্রপাত। ওই বছরের মার্চে লেফট্যানেন্ট কর্নেল জন হেনরি প্যাটারসন, একজন বৃটিশ আর্মি অফিসার কেনিয়া ও উগান্ডার মধ্যে যোগাযোগের জন্য রেলসেতু নির্মাণের কাজের তদারকিতে আফ্রিকাতে আসেন। ভারত থেকে এই কাজের জন্য হাজারে হাজারে শ্রমিক আনা হয়েছিল। এদের থাকার ক্যাম্প মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ছিল। প্যাটারসন প্রথমে খবর পান দুজন শ্রমিক সিংহের শিকার হয়েছে। সপ্তাহ খানেক পরে অঙ্গন সিং নামে একজন মিলিটারি অফিসারের সঙ্গে ঘোরার সময় ভারতীয় অফিসারটি তার সামনেই সিংহের শিকার হন। সেই রাত গাছে কাটিয়ে প্যাটারসন প্রতিজ্ঞা করেন সিংহটাকে তিনি মারবেন। গাছে বসেই তিনি আধ মাইল দূরে শ্রমিকদের ক্যাম্পের কাছে সিংহের গর্জন আর মানুষের আর্তনাদ শুনতে পান। পরেরদিন সকালে ক্যাম্পের অন্য অংশে আবার সিংহ হানা দেয়। তারা বোঝেন দুটো বড়ো সিংহ হানা দিচ্ছে, আর এরা দুজনেই কেশরবিহীন। এরপর শুরু হয় প্যাটারসনের সিংহ শিকারের প্রচেষ্টা। কিন্তু সিংহদুটো কয়েক মাসের জন্য হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে যায়। তবে তাদের তর্জন গর্জন দূর থেকে প্রায়ই শোনা যেত। এরপর সিংহদুটো আবার ফিরে আসে, আর ফিরে আসে অনেক বেশি বেপরোয়া হয়ে। একা একা ক্যাম্পে হানা দেওয়ার বদলে, তারা একসাথে এসে অতর্কিতে হানা দিতে শুরু করে। যাইহোক, সে বছর ডিসেম্বরে প্যাটারসন দুটো সিংহকেই শিকার করেন।
প্যাটারসন এই সিংহ দুটোর দেহাবশেষ রেখে দেন। পরে ১৯২৫ সালে তা শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়াম অফ ন্যচারাল হিস্ট্রিকে বিক্রি করে দেন। কয়েক দশক পরে মিউজিয়ামের কালেকশান ম্যানেজার ইকোলজিস্ট টমাস গনোস্ক সিংহের খুলির দাঁতের ফাঁকে রোমের অংশ দেখতে পান। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, সিংহের দাঁত খারাপ হওয়ার কারণে বড়ো শিকার ধরতে অসুবিধা হত, তাই এরা মানুষ শিকার করত। বর্তমানে গনোস্ক ও তার সহকর্মীরা সিংহের দাঁতে পাওয়া এই রোমের মাইক্রোস্কোপিক ও জিনগত বিশ্লেষণ করেছেন। তারা তাদের গবেষণার রিপোর্ট কারেন্ট বায়োলজিতে প্রকাশ করেছেন। প্রথমে তারা দাঁতের ফাঁকে পাওয়া রোমের বয়স নির্ধারণ করে দেখেছেন। তারপর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যার থেকে সিংহের শিকারের নমুনা মিলেছে। যারা শিকার হয়েছিল, তারা হল জিরাফ, অরিক্স, ওয়াটারবাক, বন্যহরিণ, জেব্রা। এমনকি সিংহের রোমেরও নমুনা মিলেছে। যার থেকে বোঝা গেছে, এই সিংহদুটো একে অন্যের ভাই ছিল।
সিংহের শিকারের মধ্যে মাত্র একটা মোষের নমুনা মিলেছে। কিন্তু সাভোর সিংহরা মূলত মোষ শিকার করে থাকে। প্যাটারসনের ফিল্ড জার্নালে ওই অঞ্চলে মোষ বা কোনো গবাদি পশুর উল্লেখ নেই। এই সমস্ত খুরওয়ালা প্রাণীরা রিন্ডার পেস্ট নামে এক ভাইরাল অসুখে আক্রান্ত হয়েছিল। এই রোগ ভারত থেকে আফ্রিকায় হানা দিয়েছিল। ১৮৯০ সাল নাগাদ এই অসুখে ওই অঞ্চলে পশুদের সংখ্যা কমে গিয়েছিল। আর এই কারণেই সিংহদুটো মানুষকে আক্রমণ করত। গবেষকরা জানিয়েছেন, রোম বিশ্লেষণ করে কোন মানুষ এই সিংহের শিকার হয়েছিল, তা বের করা যেতে পারে। কিন্তু তাদের পরিবারের কথা ভেবে মানবিক কারণে এই বিশ্লেষণ আর করা হবেনা।