অক্ষয়কুমার দত্ত: ‘জগতের অপরিবর্তনীয় স্বাভাবিক নিয়ম শিক্ষা’

অক্ষয়কুমার দত্ত: ‘জগতের অপরিবর্তনীয় স্বাভাবিক নিয়ম শিক্ষা’

আশীষ লাহিড়ী
Posted on ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

বাবার মৃত্যুর পর (১৮৩৯) অক্ষয়কুমার দত্ত-কে(১৮২০-১৮৮৬) ওরিয়েন্টাল সেমিনারির পড়া অসমাপ্ত্‌ রেখে রোজগারের ধান্দায় নামতে হল। জ্যাঠতুতো দাদা হরমোহন বললেন, আইন পড়, অনেক রোজগার করতে পারবি। কয়েক দিন একটানা আইনের বই পড়ে বিরক্ত হয়ে অক্ষয়কুমার বলেছিলেন, ‘যে নিয়ম নিত্য নিত্য পরিবর্তিত হয়, তাহা শিক্ষা করিয়া আমার কি ফল হইবে? আমি জগতের অপরিবর্তনীয় স্বাভাবিক নিয়ম শিক্ষা করিতে চাই।’
এর তাৎপর্যটি ভেবে দেখবার মত। আইন মানুষের তৈরি, তা মানুষের ইচ্ছামতো বদলায়। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম মানুষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ। মানুষ ইচ্ছা করলেও তাকে বদলাতে পারে না।
আজ আমরা টমাস কুন-এর প্যারাডাইম তত্ত্ব, কার্ল পপারের ফলসিফায়েবিলিটি তত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন বিতর্ক্‌, সর্বোপরি পোস্ট-মডার্নিজমে সিঞ্চিত হয়ে মহাপণ্ডিত হয়ে গেছি। তাই ‘জগতের অপরিবর্তনীয় স্বাভাবিক নিয়ম জানা’-এর কথা শুনলেই আমরা উচ্চাঙ্গের হাসি হাসব। কিন্তু একবার ভাবুন তো, উনিশ শতকের তিরিশের দশকে একটা উপনিবেশে বসে ও কথাটা বলা কতখানি সাহসের পরিচয় ছিল। তখনো খোদ ইউরোপে ডারউইন-ওয়ালেস-এর বিবর্তন তত্ত্ব অনাগত, যদিও চার্লস লায়েল-এর ভূতত্ত্বের মধ্যে সে-তত্ত্বের পূর্বাভাস ফুটতে শুরু করেছে। খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকরা মার-মার করছেন, ধার্মিক বিজ্ঞানীরাও দ্বিধাগ্রস্ত।
দার্শনিক দিক থেকে অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়মের ‘অপরিবর্তনীয়তা’র ভাবনা ক্রমে জোরদার হচ্ছিল। নিউটনের বন্ধু জন লক সেই নিয়মনুগতার ভিত্তিতেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর দর্শন। উইলিয়াম হিউওয়েল (William Whewell) গণিতকে ‘অপরিবর্তনীয় বিদ্যাসমূহের’ (‘permanent studies’) মজ্জাস্বরূপ বলে ঘোষণা করেছিলেন। জন স্টুয়ার্ট মিল, আউগুস্ত কোঁৎ যুক্তি আর বিজ্ঞানের ভিত্তিতে মানুষের সামাজিক সংগঠন গড়বার কথা ভাবছিলেন। অল্প কালের মধ্যে এসে পড়বেন কার্ল মার্ক্স।
তাই বর্ধমান জেলার চুপীগ্রাম থেকে খিদিরপুর হয়ে তখনকার কলকাতার আহিরীটোলায় পড়তে আসা কিশোরটি সেদিনের ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর দর্শনভাবনারই দোসর ছিল। একমাত্র বিদ্যাসাগরকে বাদ দিলে তার সহমর্মী তখন আর কেউ ছিলেন কি না সন্দেহ। কারণ এদেশের ইংরেজি-শিক্ষিত মহল বিজ্ঞানকে বাদ দিয়েই ইংরেজি সভ্যতাকে বরণ করেছিল। স্বয়ং ডিরোজিও কিছুই বিজ্ঞান জানতেন না। অক্ষয়কুমারের সঙ্গে প্রতিতুলনা করা যেতে পারে প্রায়-সমবয়সী মধুসূদন দত্তর, যিনি শুধু ইংরেজি নয়, ইউরোপীয় সংস্কৃতির খুব গভীরে ডুব দিয়েছিলেন। কিন্তু মধুসূদন সেই সংস্কৃতির যা প্র্‌ধান অঙ্গ্‌ সেই বিজ্ঞান কতটুকু জানতেন? হিন্দু কলেজে তাঁর পড়াশোনার খতিয়ান দিয়ে গোলাম মুরশিদ লিখেছেনঃ ‘ মাইকেল কোনোদিন বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারেননি। ভূগোলেও তাঁর জ্ঞান ত্যেমন গভীর ছিলো বলে মনে হয় না। নয়তো, তিনি ইংল্যান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে বড়ো বড়ো পর্বত আর উপত্যকার কথা লিখতেন না।’ মাইকেলের মতো ধনী ঘরের বেপরোয়া ‘সাহেব’ বাঙালি’র পাশে ছা-পোষা ঘরের ছেলে অক্ষয়কুমারের চিন্তাধারার অনন্যতা সুস্পষ্ট। ভূগোলে তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর লেখা ‘ভূগোল’ বই বহুকাল ছাত্র্‌পাঠ্য ছিল। ভালো করে ভূগোল না জানলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকে, বলতেন তিনি।
কিন্তু আসল প্রশ্নের উত্তর আমরা এখনো পাইনিঃ কীসের তাড়নায় বিজ্ঞান-বিরহিত এই উপনিবেশে বসে অক্ষয়কুমার সেই যুগে বিজ্ঞানকেই তাঁর সকল জিজ্ঞাসার মাধ্যম বলে মেনে নিলেন? প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পালটা কোনো বিশ্বাসের জমি খুঁজে নেওয়ার তাগিদই তাঁকে এদিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ধর্মও তো এক ধরনের শাশ্বত ‘অপরিবর্তনীয়তা’র কথা বলে। সেটা যে সর্বৈব ভুল, তা তিনি সেই বয়সেই, সেই যুগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই ধর্ম নয়, “প্রকৃতি”র অপরিবর্তনীয় নিয়ম শিক্ষাই তাঁর জীবনের ব্রত হয়ে উঠেছিল। এইখানেই তাঁর অনন্যতা। এইখানেই তিনি যুগের থেকে বহু যোজন এগিয়ে ছিলেন।
আর একটা বিষয় ভাবলেও অবাক হতে হয়। অক্ষয়কুমার অনেকগুলি ভাষা জানতেন। বাংলা, সংস্কৃত আর ইংরেজি তো ছেড়েই দিলাম; হিব্রু, ল্যাটিন আর জার্মান জানতেন, অল্পবিস্তর ফরাসিও। স্বয়ং বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ইংরেজি ও নানা বিদ্যায় এত পারদর্শী সেই সময় আর কেউ ছিলেন না। অথচ সেই অক্ষয়কুমার সারা জীবনে কখনো বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষায় লেখেননি। পৌত্র্‌ সত্যেন্দ্র্‌নাথ দত্ত্‌র ভাষায়, ‘শিখিব ও শিখাইব – এই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র্।’ বিজ্ঞান জানা ও জানানো – দুটোই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিজ্ঞান জানতে হলে ঐতিহাসিক কারণে ইংরেজি, জার্মান, ফরাসির দ্বারস্থ্‌ হওয়া ছাড়া গতি নেই; কিন্তু বিজ্ঞান জানাতে গেলে নিজের ভাষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই সত্য্‌টা সে যুগে অক্ষ্‌য়কুমার দত্ত্‌র মতো স্প্‌ষ্ট্‌ করে আর কে বুঝেছিলেন?
এই সব কারণে উনিশ শতকের মহাকায় বাঙালিদের মধ্যেও অক্ষয়কুমার দত্ত অনন্য।