বিজ্ঞান বিষয়টি যে ঠিক কী, তার সহস্রভাগের একভাগ হৃদয়ঙ্গম করতে লাগল আমার ১৭টি বছর। দাদুর হাত ধরেই বিষয়টির প্রতি আগ্রহ জন্মাতে থাকে বাল্য বয়স থেকে। প্রথম প্রথম বিজ্ঞান ও গণিত এই দুটি পৃথক বিষয়ের পাঠ্যবই পড়তে হত এবং ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান শিক্ষায় এই ধারাটি বজায় থাকে। গণিতের প্রতি প্রথম থেকেই আকর্ষণ আমার সবচেয়ে বেশি ছিল, হয়তো সবসময় ফুল মার্কস পেতাম বলেই। বিজ্ঞান বিষয়টিও পড়তে ভাল লাগত। তবে সেই বয়সে বিজ্ঞান শেখার থেকে পড়াটাই যেন বেশি প্রাধান্য পেত, আর সেটাই স্বাভাবিক। আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, বিদ্যালয়ের সাবভৌম উৎকর্ষ পুরস্কার হাতে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই – “বড়ো হয়ে সোহম কী হতে চাও?” ছোটবেলা থেকে সবার মুখে শুনে আসছি ডাক্তার ! বড়ো হয়ে আমার ছেলে ডাক্তার হবে- আশা যে শুধু মায়ের সেটা বললে বোধ হয় হবে। সব বাবা-মায়ের ইচ্ছা তাদের সন্তান যেন দুধেভাতে না থাকে! কেন জানিনা আমি সেদিন বলেছিলাম ‘বড়ো হয়ে বিজ্ঞানী হতে চাই’ প্রথম সপ্তম শ্রেণিতে আমাদের বিজ্ঞানের দুটি শাখা শেখানো শুরু হয় – ভৌতবিজ্ঞান আর জীবনবিজ্ঞান । আগ্রহ- আকাঙ্ক্ষা-যুক্তি-তর্ক-বাস্তব-অবাস্তব এসব যে বিজ্ঞানের স্বীকৃত অঙ্গ তা উপলব্ধি করতে শুরু করি। ভৌতবিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের প্রথম অধ্যায় যেন আজীবন হৃদয়ের মণিকোঠায় অতিযত্নে সুরক্ষিত থাকে, সেটাই চাই। প্রথমবার গল্পের ছলে নয়, বিজ্ঞানের ভাষায় বিজ্ঞানীদের চিনতে শিখি। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি ভি রমন প্রমুখ বিজ্ঞানীসহ বেশ কিছু গণিতজ্ঞ যেমন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, রামানুজম প্রমুখ চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের জীবনসাধনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ, তাদের আদলে নিজেকে গড়ে তোলার দিবাস্বপ্নের বীজ বপন করে দেয় আমার মনে । অণু-পরমাণু-প্লবতা-শ্বসনতন্ত্র-রেচনতন্ত্র-পৌষ্টিকতন্ত্র এসবকিছুই ভীষণ উপভোগ করতাম। উপভোগ আর উপলব্ধি – এই দুয়ের পার্থক্য আজ বিদ্যালয়জীবনের মোহনায় দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি। তবে এটাও ঠিক যে, উপভোগ করেছিলাম বলেই বোধ হয় আজ উপলব্ধি করার ইচ্ছেটা অগাধ।
অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে একইভাবে বিজ্ঞানের সাথে আমার সখ্য দৃঢ় হতে থাকে। বিষয়টির গভীরতা আর মনের গভীরতা তার স্থান দুটোই স্পষ্টতর হয়। নবম শ্রেণিতে নিউটনিয়ান মেকানিক্স আর আলোকবিজ্ঞানের সূচনা হয়। সত্যি বলতে দুটোই আমার ভালো লাগত না। দশম শ্রেণিতে যদিও আলোকবিজ্ঞান, তড়িৎবিজ্ঞান এবং জীবনবিজ্ঞানের সমস্ত পাঠক্রম নিখুঁত ভাবে বোঝার ইচ্ছে বাস্তবিকভাবেই গড়ে ওঠে । ইচ্ছা জাগতেই থাকে আরও অনেককিছু জানার। এই প্রথম পাঠ্যসূচিকে অতিক্রম করে যাওয়ার একটা ইছে দানা বাঁধে। কিন্তু এই বছরটিতে আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল শরীরকে দমিত করে রাজ্যের মধ্যে মেধাতালিকায় স্থান দখল। তাই ইচ্ছা করত কবে মাধ্যমিক শেষ হবে আর বিজ্ঞান বিভাগের মোটা বইগুলি পড়ার সুযোগ পাবো। স্বপ্নটা সত্যি হওয়ার জন্য দুটি মাস সময় নিয়েছিল। প্রকৃত অর্থে যেন এবার বিজ্ঞান শিখতে শুরু করলাম – নম্বরের জন্য নয়, নিজের জন্য। এতদিন স্যার নিউটনের গল্প পড়তে, তার সূত্র অপেক্ষা বেশি ভাল লাগত- অন্তত নবম শ্রেণিতে তো তাই’ই। এর উলটোটা হতে শুরু হয়। মেকানিক্স আমার প্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমবার পাঠ্যসূচির বাইরে পড়ার ইচ্ছে চরিতার্থ করতে পেরে অন্যরকম অনুভূতির স্বাদ আস্বাদন করি- হ্যাঁ আজও তাই। শুধু ঠিক পড়া নয়, এই প্রথমবার যেন বিজ্ঞানের যুক্তিতর্ক সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করার ইচ্ছে জন্মেছে। তাই তো মায়ের দই-হলুদের ফোঁটা, জলপূর্ণ ঘট এসবের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। এখন নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি বিজ্ঞান ঠিক কী কারণে পড়ি? কেনই বা রাত জেগে এইচ সি ভার্মার ভিডিও লেকচার ইউটিউবে দেখি ? কেন কেপলারের সূত্র নিজে প্রমাণ করার ইচ্ছে জাগে, ঠিক কেন নিউটনিয়ান গ্র্যাভিটেশন ছেড়ে আইনস্টাইন-এর স্পেস টাইম গ্র্যাভিটি পড়তে ইচ্ছে হয় ? কেনই বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স শিখতে ইছে করে? নিজে নিজের প্রোগ্রামের কোড বানানোর চিন্তা কেনই বা আসে ? শিক্ষকদের শেখানো পদ্ধতি অবলম্বন না করে নিজের মেথড বার করার ইচ্ছেটা কেন জন্মায় ? সবসময় পদার্থবিদ্যা আর অঙ্কের বই আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে কেন ? কেনই বা সব বিক্রিয়ার কলাকৌশল জানার ইচ্ছায় শিক্ষকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলি ? – একটা সোজা সাপটা উত্তর বোধহয় , “ আমার ভাল লাগে বিজ্ঞান, ভাল লাগে সমস্ত কিছু ছোটোখাটো ঘটনার জিনিসের অন্তর্নিহিত বৈজ্ঞানিক কারণটা খুঁজে বার করতে, আমার ভাল লাগে অজানা রহস্যের স্বরূপ উদঘাটন প্রত্যক্ষ করতে। আবার বিজ্ঞান না পড়লে, নম্বর না পেলে কোথাও ঠাঁই নেই – এটা যে কঠিন সত্য! ভালো না বাসলে ভালো ফলও হবে না। আর সাফল্যের গর্বে গর্বিত না হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করার মতো মিথ্যে যে নিজের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন তো আমাদের হাঁটাচলা – তাতেও ঘর্ষণ বলের কী প্রভাব – আমাদের কথা বলা অনুভূতি দেখা শ্রবণ – চারপাশের সমস্ত প্রত্যক্ষ করা জিনিসের আবস্ট্র্যাকশান এবং ইউস – এর কমপ্লেক্সিটি খোঁজাটা অভ্যাস করতে পারা আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। আমার ভালো লাগে ঠাকুমার চশমার লেন্সের ফোকাল লেন্থ নিজে বার করতে। একটা পাখিকে উড়তে দেখলে মনে হয় আর্কিমিডিসের উদ্দেশ্যে ভক্তিবিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি উৎসর্গ করি ; সুসামাজিক অভিধানে স্থান না পাওয়া ‘বয়সের ধর্ম’গুলিকে হাইপোথ্যালামাসের ঘাড়ে চাপিয়ে সভ্যতার পশ্চাদমুখীনতায় সরব হতে ইচ্ছে করে।
এখন বিজ্ঞানের উপভোগ আর উপলব্ধি দুটোই অবচেতন মনের অধিকাংশ ভাগ দখল করে নিয়েছে। তবে চেতনাটা শুধু নিজের ছোটো জগতে সীমাবদ্ধ নেই; বহির্জগতের নানা ঘটনা আমাকে উদ্বেলিত করলে আমার বিবেক যেন বলে ওঠে, আমাদের সার্বিক উন্নতির পথে প্রধান বাধা প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব। কেন জানিনা আমার মনে হয় সকল রাজনৈতিক সামাজিক অবক্ষয়ের মূলে বোধ হয় প্রকৃত শিক্ষার অভাব। আজ বহু অন্ধবিশ্বাসের সামনে রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে জাগে সার্বিক ভাবে প্রকৃত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে। আমার পদার্থবিদ্যার শিক্ষক একদিন আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমার প্রতি সমাজের ও সমাজের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা কী?’ প্রশ্নের সদুত্তর কবে পাবো জানি না, সময় পেলে ভাবি। বিবেক প্রত্যুত্তর দেয় অনেক বড়ো কিছু কর্তব্যের কথা। কিছু আবিষ্কার করে সমাজের অগ্রগতিতে ইন্ধন জোগানোটা তো অনেক দিন আগেকার ইচ্ছে- বিজ্ঞান পড়ছি তাই বিজ্ঞানকে absorb না করে রন্ধ্রে রন্ধে absorb করে সমাজ ও সভ্যতাকে ব্ল্যাকবডির মতো সমস্তটা রেডিয়েট করা। প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা প্রত্যেককে। এবং সবার আগে নিজেদেরকে- এটাই হয়তো বিজ্ঞান শেখার আদর্শ। তবে এসব স্বপ্ন-দায়িত্ব-কর্তব্য-আদর্শ-ভাবাবেগ-এর ‘হিমকুঞ্চিত জরায়ু’ ছিঁড়ে একটা প্রশ্নের ফ্রিকোয়েন্সি অন্য সব কম্পাঙ্ককে ছাপিয়ে গুরুমস্তিষ্ককে নাড়া দেয়- ‘এত কিছু করার সময় নেই, সামনে পরীক্ষা- তারপর আরও বড়ো কিছু। একবার আইআইটিতে চান্স , ব্যাস!’ প্রাসঙ্গিকভাবেই দ্বিতীয় মন জানান দেয়, ‘ফ্যারাডে ফাইনম্যান আইনস্টাইন হকিং-এর মতো পূজ্য ব্যক্তিদের চিন্তাধারার সমাজ সভ্যতার অন্ধকারে আলোর দিশারীর মতো ছড়িয়ে দিতে আমি না হলেও আমরা তো পারি। বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে বিজ্ঞান সাধনায় জীবন উৎসর্গ ক’রে আবিষ্কার না করলেও , তার পথ তো প্রশস্ত করাই যায়।’ ১৪৯ বছর বয়স্ক অমর বিজ্ঞানীর ভাষায়, ‘বিজ্ঞানের আবিষ্কারক নয়, আবিষ্কারই বড়ো কথা।’