ডিম্বানু বা শুক্রাণুর পরিবর্তে স্টেম-সেল থেকে কৃত্রিমভাবে তৈরি হচ্ছে মানুষের ভ্রূণ। এমনটাই দাবি করেছেন ইউরোপ এবং মার্কিন বিজ্ঞানীদের একটি দল। এই কৃত্রিমভাবে তৈরি মানুষের ভ্রূণের নাম “synthetic human embryos”। গবেষণাটি যদিও পর্যালোচনা স্তরে রয়েছে তবুও বোস্টনে স্টেম সেল রিসার্চের বার্ষিক সম্মেলনে গবেষণাটিকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আগে ইঁদুরের মধ্যে প্রমাণিত এই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ভ্রূণের বিকাশ সম্বন্ধে জানতে পারেন, যদিও এই সম্পর্কিত তথ্য আজও তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
বর্তমানে, বেশিরভাগ দেশের আইনে বলা হয়েছে গবেষণার জন্য ভ্রূণ বা ভ্রূণের মতো আকৃতি পরীক্ষাগারে ১৪ দিনের বেশি রাখা যাবেনা। কিন্তু সৌভাগ্যবশত স্টেম-সেল থেকে তৈরি ভ্রূণ এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না। স্বভাবতই এক্ষেত্রে নিয়ম এড়িয়ে দুই সপ্তাহের পরেও ভ্রূণের বিকাশ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষকরা তাদের কৃত্রিম ভ্রূণ নিয়ে ১৪ দিনের বেশি সময় ধরে গবেষণাগারে কাজ চালিয়ে গেছেন এবং ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় এই আবিষ্কারের বিষয়ে প্রথম রিপোর্ট করা হয়েছিল। কিন্তু এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে এই ভ্রূণ আদৌ মানুষে পরিণত হতে পারে কিনা, বা তাদের অন্যান্য ভ্রূণের মতো একই নিয়মের অধীন হওয়া উচিত কিনা।
অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক প্রফেসর রাচেল অ্যাঙ্কেনির মতে মানুষের বিকাশের প্রাথমিক স্তর সম্বন্ধে গভীরভাবে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমেই বন্ধ্যাত্ব, গর্ভপাত এবং বিকাশকালীন ত্রুটিগুলির সুরাহা করা যাবে। তিনি আরও বলেন যে যেহেতু এই জৈবিক প্রক্রিয়াগুলি আমাদের মূল্যবোধের সাথে গভীরভাবে আবদ্ধ সেই কারণে মানব বিকাশের বিষয়ে জনসাধারণের উপলব্ধি এবং প্রত্যাশা সম্পর্কে অবহিত হতে হবে।
সিডনি ইউনিভার্সিটির ডক্টর ক্যাথরিন ম্যাকায় বলেছেন যে, ভ্রূণ গঠনের জন্য তাদের একটি পূর্ণ ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু কোশের প্রয়োজন না থাকলেও, ভ্রূণের বিকাশের জন্য মানব ভ্রূণ কোশের প্রয়োজন। স্বভাবতই গবেষণার জন্য আমাদের মানুষের ভ্রূণ ব্যবহার করতে হচ্ছে আর এটি একটি নৈতিক সমস্যা, কারণ আমাদের মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাছাড়াও আর একটি নৈতিক সমস্যা হল যে গবেষণার জন্য যে কৃত্রিম ভ্রূণ তৈরি করতে হচ্ছে তা তার নিজস্ব পূর্ণ সত্তা হিসাবে বেঁচে থাকতে পারবে কিনা। যদি তারা তাদের নিজস্ব পূর্ণ সত্তা হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে, তবে আমাদের অবশ্যই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে যে গবেষণার জন্য আমরা কোনো জীবিত প্রাণী তৈরি করতে পারি কিনা বা নৈতিকভাবে তা অনুমোদিত কিনা।
প্রাণীর মডেলের মতোই কৃত্রিম মানব ভ্রূণ থেকে মানব শিশুর জন্ম হবে না। এর থেকে দুটো প্রশ্ন উঠে আসে – এক, যদি এই ভ্রূণ মানব শিশুতে পরিণত হতে না পারে, তবে মানব প্রজনন এবং বিকাশের ক্ষেত্রে এটি কতটা কার্যকর? এবং দুই, এই ভ্রূণ থেকে যে মানব শিশুর জন্ম হচ্ছে না –এই বিষয়কে কেন্দ্র করে গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আদৌ ফলপ্রসূ হবে কিনা?
অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা অব্যশ্য বলেছেন যে, সন্তান ধারণ এবং ভ্রূণের বিকাশ ছাড়াও, জিনগত রোগ, দীর্ঘায়ু এবং বার্ধক্য সম্পর্কে জানার জন্য এই কৃত্রিম ভ্রূণ ব্যবহার করা যেতে পারে। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াজসিচ ক্রজানোস্কির মতে সম্ভবত এই গবেষণাটি মানুষের বিকাশকালীন ত্রুটি নিরাময়ের জন্য নতুন চিকিত্সা পদ্ধতির পথ দেখাবে, এবং সম্ভবত জীবনকালও বাড়িয়ে দেবে।