কোভিডের প্রতিষেধকের নামে বিজ্ঞানের প্রতারণা!

কোভিডের প্রতিষেধকের নামে বিজ্ঞানের প্রতারণা!

সুদীপ পাকড়াশি
Posted on ১০ অক্টোবর, ২০২১

কোভিডের অলৌকিক প্রতিষেধক বেরিয়ে গেল? আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ইউরোপ জুড়ে এই ওষুধ নিয়ে সাধারণ মানুষ উত্তাল! এই ওষুধকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিলও বেরিয়ে গিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন শহরের রাস্তায়। ওষুধের নাম আইভারমেকটিন। গত কয়েক বছর ধরেই আইভারমেকটিন ব্যবহ্রত হচ্ছে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর ওপর। অ্যান্টি-প্যারাসিটিক ওষুধ হিসেবে। কিন্তু কোভিড মহামারীর ধাক্কায় মানুষের রাতে ঘুম চলে যাওয়ার পর থেকে কোভিড নিয়ে প্রবক্তাদের একাংশের মধ্যে বিরাট কোলাহল যে, আইভারমেকটিন কোভিডের একমাত্র প্রতিষেধক। শুধু তাই নয়, এই ওষুধ কোভিডে আক্রান্ত রোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরিয়ে আনছে!
এই প্রবক্তারা কারা? মূলত সেই মানুষ যারা টীকার বিরোধিতা করে আসছেন। তারা রীতিমত আন্দোলনে নেমে পড়েছেন এই ওষুধকে কোভিডের প্রতিষেধক হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করার জন্য। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো এরকমও দাবি তোলা হয়েছে যে, অন্যান্য প্রাণীর চিকিৎসায় যে আইভারমেকটিন দেওয়া হয় কোভিডে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায়ও সেই আইভারমেকটিন দেওয়া হোক! তাতেও গুরুতরভাবে কোভিডে আক্রান্ত রোগী বেঁচে যাবে! আইভারমেকটিনের প্রচারকরা চিৎকার করছেন এই বলে যে, এই ওষুধে যে কোভিডে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে উঠছে সেই তথ্যগুলো উপেক্ষা করা হচ্ছে।
কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক, কোভিড নিয়ে অবিরাম গবেষণা করে যাওয়া বিজ্ঞানীরা বেঁকে বসেছেন! তাদের দাবি, কোভিডের প্রতিষেধক বলে আইভারমেকটিনকে নিয়ে যা রিসার্চ করে হয়েছে তার মধ্যে অনেক গলদ আছে। শুধু গলদ নয়, অনেক চিকিৎসকের অভিযোগ, কোভিডে আইভারমেকটিনের কার্যকারিতা নিয়ে যে গবেষণা করা হয়েছে বা হচ্ছে, সেখানে ‘প্রতারণাও’ করা হয়েছে!
বিবিসিও নেমেছিল এই অনুসন্ধানে। তারা জানিয়েছে, ২৬টি গুরুত্বপূর্ণ ট্রায়ালের এক তৃতীয়াংশ পরীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে আইভারমেকটিনের কোনও কার্যকারিতাই নেই! কাইল শেল্ড্রিক, যিনি অনুসন্ধানকারীদের মধ্যে অন্যতম, বলেছেন, “একটা সিঙ্গল ক্লিনিকাল ট্রায়ালেও দেখতে পাইনি আইভারমেকটিন খেয়ে গুরুতরভাবে কোভিডে আক্রান্ত কোনও রোগী বাঁচল! তার মানে কোভিড আর আইভারমেকটিন নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তাতে অজস্র গলদ আছে। আইভারমেকটিনের পক্ষে যা প্রচার চলছে সেটা অতিরঞ্জিত।” আইভারমেকটিন নিয়ে করা গবেষণায় ত্রুটির কথা প্রকাশ করেছে বিবিসি। প্রথমত, এই গবেষণা সম্পর্কে স্থানীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক অবহিত ছিল না। দ্বিতীয়ত, একজন রোগীকে পরীক্ষা করে পাওয়া তথ্যই একাধিক রোগীর নামের পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে! রোগীদের ওপর পরীক্ষা বারবার করার কথা, কিন্তু সেটা হয়নি। তৃতীয়ত, গবেষণায় যে সংখ্যাগুলো দেখানো হয়েছে সেগুলো স্বাভাবিকভাবে আসেনি আর চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি, আইভারমেকটিন খেয়ে বেঁচে যাওয়া যে শতাংশ রোগীর কথা বলা হয়েছে বা হচ্ছে তার গণনায় গুরুতর গলদ!
বিজ্ঞানীদের একটা দল কোভিডে আইভারমেকটিনের কার্যকারিতা নিয়ে হওয়া ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা নিয়ে অনুসন্ধান করছেন। জেমস হিথার্স, নিক ব্রাউন, শেল্ড্রিক এবং আরও দু’একজন বিজ্ঞানী-এদের খ্যাতি আছে ভুল বৈজ্ঞানিক গবেষণা ধরে ফেলার! আইভারমেকটিন নিয়েও এরাই গবেষণা করছেন। মিশর থেকে এক বায়োমেডিক্যাল নিয়ে পড়া ছাত্র জ্যাক লরেন্স প্রথম এদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন যে আইভারমেকটিনে কোভিডের কঠিন রোগী বাঁচছে না এবং ওষুধের হয়ে যে বিজ্ঞানীরা, চিকিৎসকরা আন্দোলন করছেন তাদের গবেষণায় অনেক গন্ডগোল রয়েছে। তারপরই ব্রাউন, শেল্ড্রিকরা একটা গ্রুপ তৈরি করে ফেলেন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শুরু করেন আইভারমেকটিন নিয়ে অনুসন্ধান। তাদের অনুসন্ধান এ-ও জানিয়েছে যে, গবেষণায় এরকম অনেক কোভিড রোগীকে পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে যেখানে পরে দেখা গিয়েছে, সেই রোগীরা পরীক্ষা নেওয়ার আগেই মারা গিয়েছেন! আবার অনেক রোগীর নাম লেখা হয়েছে গবেষণায়, যাদের আদৌ কোনও অস্তিত্বই নেই!
এখনও পর্যন্ত আইভারমেকটিন নিয়ে সর্বোচ্চ স্তরে গবেষণা হয়েছে কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, কোভিডে আক্রান্ত রোগীর ওপর আইভারমেকটিন কাজ করে বলে তাদের কাছে কোনও প্রমাণ নেই! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এখন আন্দোলনের সুর বদলে গিয়েছে। প্রচুর মানুষ, তাদের সঙ্গে চিকিৎসকরাও প্রচারে নেমেছেন যে আইভারমেকটিন মানুষকে আরও অসুস্থ করে দিচ্ছে। এই ওষুধকে ‘সেফ ড্রাগ’ বলা হত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এই ওষুধ খেলে মানুষের বমি হওয়া বেড়ে যাচ্ছে, ডাইরিয়া হয়ে যাচ্ছে, মানুষের শরীর কাঁপছে, তার ঝিমুনিভাব বেড়ে যাচ্ছে।
পেরুতে, এক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিসিয়া গার্সিয়া এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, তিনি ওখানকার হাসপাতালে দেখেছেন চিকিৎসকরা আইভারমেকটিন দিচ্ছেন কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের। কিন্তু ওষুধটি খাওয়ার পর তারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সংখ্যার হিসেবও গার্সিয়া দিয়েছেন বিবিসি-কে। প্রতি ১৫ জনে ১৪ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সেই হাসপাতালে!
বিজ্ঞানের বিড়ম্বনা ছাড়া একে আর কী-ই বা বলা যেতে পারে!