খেলার পাতার মতো বিজ্ঞান পাতা থাকবে না কেন

খেলার পাতার মতো বিজ্ঞান পাতা থাকবে না কেন

দেবদূত ঘোষঠাকুর
Posted on ৫ আগষ্ট, ২০২১
খেলার পাতার মতো বিজ্ঞান পাতা থাকবে না কেন

সবাইকে অবাক করে গবেষণা, শিক্ষকতাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে সাংবাদিকতার পেশায় যোগ দিয়েছিলাম। শারীরবিদ্যার ছাত্র ছিলাম। স্নাতকোত্তর শেষে বৃত্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলাম। কিন্তু তা শেষ না করেই ঢুকে পড়লাম বাংলা সংবাদপত্রের বড়বাড়িতে।

বিষয়টি যখন সবাই জানল ভাবল হয়তো আমাকে বিজ্ঞান লেখার জন্য নেওয়া হয়েছে। আমারও অবশ্য সেরকমই মনে হয়েছিল প্রথম দিকে। কিন্তু খবরের কাগজে খেলার পাতা আছে, সপ্তাহান্তে বিনোদনের পাতা আছে, গল্প, নিবন্ধ ছাপার নির্দিষ্ট জায়গা আছে। কিন্তু কোথায় বিজ্ঞানের পাতা তো নেই! কেন নেই? বড় দাদাদের জিজ্ঞাসা করেছি। সদুত্তর পাইনি। আরও একটু অভিজ্ঞ হতে বুঝতে পারলাম, খেলার খবর, বিনোদনের খবর বিজ্ঞাপন টানতে পারে। বিজ্ঞানের খবর নয়। তাই বিজ্ঞানের খবর দুয়োরানি।

দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো কখনও আর্সেনিক দূষণ, কখনও  রোগের বিশ্লেষণ, কখনও চন্দ্রগ্রহণ, কখনও সূর্যগ্রহণ, আবহাওয়ার ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে বাংলায় বিজ্ঞান লেখার অনুশীলন চালিয়ে গিয়েছি। বিজ্ঞাপন এলো কি এলো না, তার হিসেব করিনি, কিন্তু দেখেছি পাঠক গপগপ করে গিলছে। বিজ্ঞানের লেখা বিজ্ঞাপন আনতে পারে তার প্রমাণ পেলাম ডেঙ্গির সময়ে। আমাদের বিজ্ঞাপনের এক কর্তা একদিন এসে বললেন, ‘অমুক পাতায় তমুক কোম্পানি একটা বড় অঙ্কের বিজ্ঞাপন দেবে। মশার উপরে ধারাবাহিক কোনও লেখা দেওয়া যাবে? বিজ্ঞাপনের সঙ্গেই লেখাটা যাবে। আর এক দিন নয়, পরপর তিন দিন। মশা নিয়ে নানারকম লেখা লিখতে হবে। এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েই নিলাম। কয়েক বছর পরপরই ডেঙ্গি হাজির হলে আমাকে এ ধরনের লেখা লিখতে হত।

বিজ্ঞানের লেখা বিজ্ঞাপন আনতে পারে না, সেই ভুল ধারণাটা ভাঙতে শুরু করেছিল কিন্তু। তার জেরে বিজ্ঞানের জন্য পাতা বেরোতে শুরু করল একসময়। প্রতি ১৫ দিনে নতুন বিজ্ঞান পাতা। সেই সময়টায় ৩৬ বছর চালিয়ে ব্যাট করার পরে আমি অবসর নিয়েছি।

দীর্ঘদিন একটা বড় সংবাদপত্রে কাজ করার সময় বারবারই মনে হয়েছে, বিজ্ঞান তো খেলাতে আছে, বিনোদনেও আছে। তাহলে বিজ্ঞান সংবাদের প্রতি এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ কেন? ক্রীড়া বিজ্ঞান বিজ্ঞানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। কোনও খেলায়াড় কিংবা কোনও দল কেমন ফল করল তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তখনই  সম্ভব, যখন ক্রীড়া বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলিকে সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। আমি বিদেশের কাগজে দেখেছি কী ভাবে একজন খেলোয়াড়ের শারীরিক সক্ষমতা, খাদ্যাভাস, মানসিক গঠন তাঁর দক্ষতাকে প্রভাবিত করছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ থাকে প্রতিবেদনে।  আমাদের এখানে সে সবের বালাই নেই। আমি একবার ক্রীড়া বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে খেলার পাতায় চর্চার ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু তার হালে পানি পায়নি।

বিনোদনের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান নিজ গুণেই বিরাজমান। তিনি অভিনয় করেন তিনি একজন মানুষ। যাঁরা নাটক দেখেন তাঁরাও মানুষ। একদল কর্তা। কিছু করে দেখান। অন্য দল গ্রাহক। কর্তা যা করছেন তা তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলে তবেই সেগুলি গ্রহণ করেন। কারও অভিনয় তাই ভালো লাগে। কারও অভিনয় ভালো‌ লাগে না। কর্তা  (কর্তা যা করছেন সেটাই পন্য) এবং গ্রাহকের মধ্যে  সমন্বয় সাধনকারী ওই একজনই, কোনও চেয়ারে  ওই বিজ্ঞান।

ধরুন আমি ছবি আঁকব। কোন পেন্সিল টা বা তুলি টা আমার দুই আঙুলের মধ্যে মসৃণ ভাবে  চলবে তার নির্ভর করে ওই তুলি বা পেন্সিলের নকশার উপরে। পেন্সিলের নকশা তাহলে কেমন হবে? সেটাও কিন্তু বিজ্ঞান। ছবির রঙ নির্বাচন কেমন হবে? শিল্পীর পছন্দ আর ছবি প্রেমীর পছন্দ তখন মিলে যাবে সেই ছবিটার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এটাও বিজ্ঞান। শুধু দেখার চোখটা চাই। দৈনন্দিন জীবনে যেখানে হাত দেওয়া যাবে সেটাই বিজ্ঞান। কোন চেয়ারে বসলে আরাম পাবেন, বসলে অস্বস্তি হবে না, কোন জুতো পায়ে গলালে হাঁটা একেবারে মসৃন হবে, পায়ে ব্যথা হবে না, বাসের হাতল কোথায় থাকলে, তা ধরে দাঁড়াতে সুবিধা সেটাও বিজ্ঞান।

সেই বিজ্ঞানকে কে তাহলে এত হেলাচ্ছেদা কেন?

জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সরব এবং নীরব ভূমিকাকে কী ভাবে নিত্যদিন নাড়াচাড়া করে দেখা যায় সেই সুপ্ত বাসনাকে উস্কে দিল অভিজিতের (চৌধুরী) একটা ফোন, ‘দেবদূতদা আমাদের ‘বিজ্ঞানভাস’ দৈনিক বিজ্ঞান পত্রিকা হবে। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে?’ এক মুহুর্ত ভাবিনি। যতো সহজ মনে হচ্ছে, কাজটা ততোটা কিন্তু সহজ নয়। নেমে পড়লাম। ভিতরে ভিতরে অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়েছে যে! স্কুলে সংস্কৃতের শিক্ষককে দেখলে হত। কোনও রাইট আউট বল নিয়ে আমার সামনে পড়লে হত। কলেজে গিয়ে কোনও কোনও বান্ধবীকে দেখতে পেলে হত। এখনও তেমন হচ্ছে।

বিজ্ঞান যে সর্বব্যাপী। সর্ব শক্তিমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 + 14 =