চাঁদের গায়ে কাচের পুতি

চাঁদের গায়ে কাচের পুতি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২১ জুন, ২০২৫

চাঁদের মাটিতে পা রাখার পর পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও সেই মাটি ‘বিস্ময়’ উপহার দিয়ে চলেছে। অ্যাপোলো ১৭ অভিযানের সংগ্রহে থাকা ‘লুনার গ্লাস বিড’ বা কাঁচের পুতি আজও বিজ্ঞানীদের হতবাক করে! মিলিমিটারের চেয়েও ছোট এই ঝিকঝিকে দানাগুলি, ৩.৩ থেকে ৩.৬ বিলিয়ন বছরের আগের। এগুলি চাঁদের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের স্মারক- ভূতাত্ত্বিক দিনলিপি। এই গবেষণার পেছনে কাজ করেছেন টমাস উইলিয়ামস, স্টিফেন পারম্যান, আলবার্তো সা‌ল এবং রায়ান ওগ্লিওরে। এই দল জানাচ্ছে, দানাগুলি আগ্নেয়গিরির ফোয়ারা থেকে ছিটকে বেরোনো গলে যাওয়া ব্যাসল্ট, যা শূন্যে উঠে গিয়ে, নিমেষেই ঠান্ডা হয়ে পাতা ঝরার মতো ফিরে আসে চাঁদের বুকে- আর তখনই জন্ম হয় এই ‘পাইরোক্লাস্টিক গ্লাস বিড’ বা পুতির।

১৯৭২ সালে অ্যাপোলো ১৭-এর মহাকাশচারীরা ‘শর্টি ক্রেটার’-এ প্রথম এই উজ্জ্বল কমলা রঙের মাটি খুঁজে পান। তখন থেকেই বোঝা গিয়েছিল, চাঁদের মাটিতে টাইটেনিয়াম সমৃদ্ধ ভিন্ন ধরণের ম্যাগমা রয়েছে। এগুলির মধ্যে এমন অংশও ছিল যাতে জল ছিল পৃথিবীর ম্যান্টলের সমান মাত্রায়- এক মিলিয়নের ৬১৫ থেকে ১৪১০ ভাগ! এমন তথ্য আগে কল্পনাও করা যায়নি, কারণ ধারণা ছিল চাঁদ একেবারেই শুকনো। তবে এবার গবেষকদের চোখ পড়েছে দানাগুলোর বাইরের স্তরের দিকে। সেখানে প্রমাণ আছে অতীতের বিস্ফোরিত মেঘের। অগ্লিওরের ল্যাবে, ন্যানো সিম প্রযুক্তি ব্যবহার করে একে একে বিশ্লেষণ করা হয়েছে দানাগুলির আবরণ। দেখা গেছে, তাদের গায়ে আছে স্ফালারাইট নামক খনিজ অর্থাৎ জিঙ্ক সালফাইডের স্তর। সেই স্তরের শুরুতে লোহার আর উপরের দিকে জিঙ্ক(দস্তা) বেশি। সুতরাং যখন এই দানাগুলি ছিটকে যাচ্ছিল, তখন বিস্ফোরিত মেঘ ক্রমশ ঠাণ্ডা ও পাতলা হচ্ছিল। কিছু দানার গায়ে আছে সোডিয়াম ক্লোরাইড, গ্যালিয়াম, ফ্লোরিনও। এই ধরণের উপাদান প্রমাণ করে, তখনকার আগ্নেয়গিরির গ্যাস ছিল উষ্ণ ও উদ্বায়ী ধাতুতে ভরপুর। আবরণগুলি মাত্র কয়েকশো পরমাণু পুরু, কিন্তু তাতেই চাপ, তাপমাত্রা আর গ্যাসের গঠন সম্পর্কে বিস্ময়কর তথ্য লুকিয়ে আছে। এই কাঁচের ক্ষুদ্র পুতি ভবিষ্যৎ চাঁদ গবেষণায় কার্যকর উপাদান হতে চলেছে। নাসার আর্টেমিস মিশন যেখানে যেখানে নেমে কাজ করার কথা, সেইসব অঞ্চলের আশপাশেই এমন আগ্নেয় প্রমাণ রয়েছে। দানার গায়ে থাকা খনিজ স্বাক্ষর চাঁদের আগ্নেয় ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিকোণে তুলে ধরছে। হয়তো কোনো একদিন, মহাকাশচারীরা এই পুতিগুলোর সূত্র ধরে খুঁজে পাবে জিঙ্ক বা সালফারের খনি, যা ভবিষ্যতের মহাজাগতিক বসবাসের জন্য অপরিহার্য হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 4 =