
স্বর যেখানে স্তব্ধ দু-চোখের নীরব দৃষ্টিই সেখানে হয়ে ওঠে ভাবের বাহন। বহু অবোলা প্রাণীও প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করে তাদের মনের গোপন কথা ব্যক্ত করতে, বিভিন্ন ভঙ্গিমা ও কিছু সূক্ষ্ম সামাজিক সম্প্রীতিমূলক সংকেতের মাধ্যমে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যদি খুব সচেতনভাবে লক্ষ্য করি, দেখব কুকুরেরা নানারকম মুখভঙ্গিমা করে তাদের আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ করতে চায়।গবেষকদের মতে তাদের এহেন আচরণের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম বিষয় হল বারবার চোখের পলক ফেলা। হয়তো পোষ্যদের মালিকরাও এদের পলক ফেলার বিষয়টি নিয়ে দু-বার ভাবেন না ,তুচ্ছ বিষয় ভেবে উপেক্ষা করে যান। ব্যাপারটা আমাদের সাদামাটা ধারণার চেয়েও নিগূঢ় অর্থবাহী। গবেষকরা মনে করেন এধরনের ভঙ্গিমা কুকুরদের গোপন সামাজিক সংকেত হতে পারে।
ইতালির পার্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী চিয়ারা কানোরির নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় একটি কুকুর অন্য কুকুরের চোখের পলক ফেলা দেখে নিজেরাও চোখ পিটপিট করে। ধারণা করা হয় এটি তাদের সহজাত আচরণ, যাকে মুখাবয়ব অনুকরণ বলা হয়। এই স্বভাবটি প্রাণীদের মধ্যে সামাজিক সংযোগ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
অন্য প্রাণীদের অভিব্যক্তি নকল করার বিষয়টি গবেষকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। তাঁরা ৫৪ টি কুকুরকে তিন ধরনের ভিডিও দেখান। প্রথমটিতে কুকুররা ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে , দ্বিতীয়টিতে নাক চাটছে এবং শেষটিতে কেবল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। দেখা গেছে, চোখের পলক পড়ার ভিডিও দেখার সময় কুকুরগুলো তুলনামূলকভাবে ১৬ শতাংশ বেশি চোখের পলক ফেলেছে। তবে বাকি দুটো ভিডিও দেখে তারা বিশেষ কোনো ভাব প্রকাশ করেনি।
এই ভিডিওগুলো দেখার সময় কুকুরদের হৃদস্পন্দনের বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকরা। তাঁরা দেখেন ভিডিও দেখার সময় কুকুরদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ বা চাপের লক্ষণ দেখা যায়নি বরং ভিডিও দেখার পর তাদের মধ্যে হালকা আরামবোধের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এর থেকে বোঝা যায় কুকুরেরা একে অপরের চোখের হালকা নড়াচড়া থেকে আবেগ ও সামাজিক বার্তা বুঝতে পারে এবং এটা তাদের শান্তি ও আশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ।এই ধরণের আচরণ শুধু কুকুর নয়, বিড়াল, ঘোড়া ও বানরের মধ্যেও দেখা যায়। মানুষের ক্ষেত্রেও কথোপকথনের সময় বা আবেগঘন মুহূর্তে চোখের পলক পড়ার হার বেড়ে যায়।
এই গবেষণার সীমাবদ্ধতাটি হল, কুকুরদের ভিডিও দেখানো হয়েছে, সরাসরি অন্য কুকুরের মুখোমুখি করা হয়নি। তাই গবেষকরা ভবিষ্যতে মুখোমুখি যোগাযোগের পরিস্থিতিতে একটা পরীক্ষা করে দেখতে চান ফলাফল এর থেকেও চমকপ্রদ হয় কিনা।গবেষণাটি ইঙ্গিত দেয় যে কুকুরদের চোখের পলক ফেলা শুধুমাত্র একটি শারীরিক অভিব্যক্তি নয় বরং এটি সামাজিক বন্ধন , আবেগ প্রকাশ ও তাদের মেজাজ বুঝতে সাহায্য করে।
সর্বোপরি গবেষণাটি এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে যে অবোলা প্রাণীর মন বোঝা অত সহজ নয় , এদের না বলার মধ্যেও থাকে অতি সূক্ষ্ম সংকেত যা সচেতনতা সহকারে বুঝে নিতে হয়। পোষ্য কুকুরের মালিকরা যদি এই সংকেতগুলি বুঝতে শেখেন তবে তারা খুব সহজেই তাদের পোষ্যের হর্ষ-বিষাদের ছন্দময়তাকে অনুভব করতে পারবেন।