জনস্বাস্থ্য বিধি মানাই কোভিড নিয়ন্ত্রণের মূল উপায়

জনস্বাস্থ্য বিধি মানাই কোভিড নিয়ন্ত্রণের মূল উপায়

সুদীপ পাকড়াশি
Posted on ২৮ নভেম্বর, ২০২১

অষ্ট্রেলিয়া, চিন এবং ব্রিটেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের দল যৌথভাবে কোভিড-১৯ নিয়ে প্রথমবার বিস্তৃত ও গভীরভাবে গবেষণা করল। গবেষণাটি ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার মূল বক্তব্য, পৃথিবীর যে দেশগুলোয় জনস্বাস্থ্যমূলক ব্যবস্থা মানুষ মেনেছে বা প্রশাসনিকভাবে মানুষকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে সেখানে দেখা গিয়েছে কোভিড সংক্রমণের হার অপেক্ষাকৃত কম।
২০২০ থেকে ২০২১-এর অক্টোবর পর্যন্ত ২৩৯০০৭৭৫৯ মিলিয়ন মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গিয়েছেন ৪৮৭১৮৪১ মিলিয়ন মানুষ। নানারকমের নিয়ন্ত্রন ও প্রশমন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে এই কোভিড-১৯-কে বশে রাখতে। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ এবং শিশুদের এবং হাসপাতালে ভর্তি থাকা অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরা যাতে করোনা-মুক্ত থাকতে পারেন বা আরও বড় ঢেউ না আসে তার জন্য নানারকমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
টীকাকরণ অবশ্যই এই ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সামগ্রিকভাবে বিশ্বজুড়ে টীকাকরণ সাফল্যই দিয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষণা। যদিও গবেষকরা স্বীকার করেছেন ১০০ শতাংশ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ টিকা এবং ভবিষ্যতেও ডেল্টার মত কোভিডের অন্যান্য ভ্যারিয়ান্টের বিরুদ্ধে এই টিকা কতটা প্রতিরোধ করতে পারবে সেই সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকা অন্যতম বিজ্ঞানী অষ্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেলা স্ট্যালিকের কথা শুনতে হলে বলতে হয়, যতক্ষণ না মানুষের শরীরে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বেশি সংখ্যক মানুষের পক্ষে কোভিডকে প্রতিরোধ করা কঠিন। আর ‘হার্ড ইমিউনিটি’ নির্ভর করে জনসংখ্যার ওপর, কী টীকা দেওয়া হচ্ছে তার ওপর, ভাইরাল মিউটেশনের অত অনেক কিছুর ওপর।
তাই গবেষকদের বক্তব্য, ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি যতক্ষণ না করা যাচ্ছে, জনস্বাস্থ্য বিধিগুলোই ভাইরাস থামানোর প্রথম ও প্রধান উপাদান। যার মধ্যে, গবেষকরা জানাছেন মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব পালন করার কাজ, বার বার গা হাত পা ধোয়ার কাজ নিয়মিত এবং সঠিকভাবে করতে পারলে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে প্রতিরোধ করা যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রতিরোধ করা গিয়েছে। বিশেষত করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ভ্যারিয়ান্টের সংক্রমণ খুব দ্রুত যেখানে হয় সেক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য বিধিপালনের মাধ্যমেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে প্রতিরোধ করা গিয়েছে বলে গবেষকদের পর্যবেক্ষণ।
এছাড়া রয়েছে বিশ্বজুড়ে লকডাউন। ভারত সহ অষ্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০-র অনেকটা সময় জুড়ে লকডাউন জারি করেছিল সরকারগুলো। যৌথ এই গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ, কিছু কিছু দেশে লকডাউনের ফলে সংক্রমণ কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সুবিধে পাওয়া গিয়েছে। সমীক্ষকরা জানিয়েছেন আর্থিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোও আর্থিকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবেষণায় বিশ্বের ২০২টা দেশ থেকে তথ্য পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যেকটি দেশের মধ্যে মিল একটাই যে, লকডাউনে কোভিডের সংক্রমণ কমেছিল। সামগ্রিকভাবে লকডাউনে সংক্রমণ কমার হার ১১ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, এই ১১ শতাংশের মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টকে প্রতিরোধ করাও রয়েছে। করোনারযে ভাইরাসকে নিয়ে বিজ্ঞানী, চিকিৎসকদের অনেক বেশি দুশ্চিন্তা। ভারতে লকডাউনের পর সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ১০.৮ শতাংশ সংক্রমণ কমেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় সংক্রমণের হার আর একটু কম, ১৪ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি প্রদেশের মধ্যে সার্ভে করে দেখা গিয়েছে, লকডাউন বাধ্যতামূলকভাবে চালু হওয়ার পর প্রত্যেকদিন ২ শতাংশ করে কোভিডের সংক্রমণ ২ শতাংশ করে কমেছে। ব্রাজিলে করা এই গবেষণা জানিয়েছে লকডাউন চালু হওয়ার প্রথম ২৫ দিন পর কোভিড সংক্রমণের হার লকডাউনের আগে যা ছিল তার সঙ্গে তফাৎ ছিল ২৭.৪ শতাংশ! প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখার ফলে সংক্রমণের হার কমেছে ৬২ শতাংশ, কোভিডে মৃত্যুর হার কমেছে ৫৮ শতাংশ।
তবুও বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে লকডাউন চূড়ান্ত সমাধান নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ অনুন্নত দেশ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে মহামারী এসে গিয়েছিল। কোটি কোটি নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। তাই এই গবেষণা বলছে আরও ‘টেলর-মেড ইনভেনশনের’ (উপযোগী পন্থা) প্রয়োজন। যাতে সামাজিক জীবন ব্যহত না হয়, অর্থনীতির গতি স্তব্ধ না হয় অথচ ভাইরাসের সংক্রমণকে প্রতিরোধ করা যায়, নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এরকম প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন করা। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, জনস্বাস্থ্য বিধি পালনকে বাধ্যতামূলক করলেই শুধু কাজ হবে না। একইসঙ্গে দেখতে হবে তার প্রভাব মনুষ্যজীবনে কতটা পড়ছে এবং নেতিবাচক দিকগুলোর, যেমন মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া, সমাধান করা যাচ্ছে কি না।
এই গবেষণা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকের দ্বিধা আছে, দ্বিমতও আছে। কিন্তু উপসংহার সকলের এক। শুধু প্রচুর পরিমাণে টীকা দিয়ে সমাজজীবন থেকে করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। তার সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিধিগুলোও পালন করা বাধ্যতামূলক।