ধরুন আপনি বাড়ির বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। হঠাৎ করে কনুই এর কাছে কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করলেন, দেখলেন একটা ছোট্ট মশা বসে আছে। হাত তুলে মারতে যাবেন তখনই ব্যাটা উড়ে পালাল। আপনি তখন মশাকে শাপশাপান্ত করতে করতে কনুই চুলকোতে লাগলেন।
এর আগে কী কী ঘটে গেল?
মশাটার গাল ভরা বৈজ্ঞানিক নাম এইডিশ ইজিপ্টি। ডাক নাম ধরে নিন খেদি। খেদি একটা স্ত্রী মশা, পুরুষ মশা কামড়ায় না। গাছের পাতার রসেই ওদের পুষ্টি হয়ে যায়। স্ত্রী মশার ক্ষেত্রেও তাই হয়। কিন্তু বংশ বিস্তারের সময় ওদের প্রয়োজন হয় রক্তের। এবারে খেদিরও তাই রক্তের দরকার। ও শরীরে পুরুষ মশার শুক্রাণু জমিয়ে রাখতে পারে অনেকদিন ধরে, একটু একটু করে কয়েকটা ব্যাচে সেই শুক্রাণু দিয়ে নিজের নিষিক্ত ডিম পাড়তে পারে। এক এক বারে কয়েকশো।
খেদির রক্তের দরকার। তাই ও উড়ে এল আপনার চামড়ার কাছে। চামড়ার উষ্ণতা, ঘাম ওকে বলে দিল রক্ত কাছাকাছিই আছে। খেদি এবারে কনুই এর চামড়ায় বসল। ওর মুখের কাছে থাকা প্রোবোসিস একটা আশ্চর্য যন্ত্র। এই প্রবোসিসের মধ্যে থাকে সুক্ষ্ণ সুঁচ, সেটাকে চামড়া ভেদ করে পৌঁছে দেয় রক্ত জালিকার মধ্যে। এবারে এবারে খেদি রক্ত শুষতে থাকবে, কিন্তু তার সাথে সাথেই রক্তে মিশিয়ে দেবে ওর থুতু। থুতুতে থাকা এক রকমের রস খেদির শুষতে থাকা রক্ত জমাট বাঁধতে দেবে না। আপনি যখন টের পেলেন ততক্ষণে খেদির কাজ আধা শেষ। হাতটা চামড়ার ওপরে এসে পড়ার আগেই ও পালিয়েছে। কিন্তু ও আবার ফিরে আসবে, আরেকবার কামড়াবে আপনাকে, যতক্ষণ না ওর পেট ভরে যাচ্ছে রক্তে। তারপরে উড়তে উড়তে কোন জমে থাকা জলে বসে মনের সুখে ডিম পাড়বে।
এবারে এতে আপনার কী ক্ষতি? আপনার শরীরের ৫ লিটার রক্তের মধ্যে খেদি ০.৫ মিলিলিটার রক্তও খায়নি। কিন্তু রক্ত খাওয়ার সময় খেদির নিজেরই অজান্তে আপনার রক্তে মিশিয়ে দিয়েছে একটা ভাইরাসকে। তার নাম ডেঙ্গু।
ডেঙ্গু ভাইরাস মনের সুখে বাড়তে থাকবে এবারে শরীরে। জ্বর আসবে, গাঁটে গাঁটে ব্যথা হবে। সাধারণত শরীর ভাইরাসকে নিজেই প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গু মারাত্মক রকমের টেঁটিয়া। বার বার বদলাতে থাকে নিজেকে, তাই শরীর অনেক সময় চিনতেও ভুল করে। তখনই এটা মারণ রোগের আকার নেয়। রক্তের অনুচক্রিকা বা প্লেটলেটগুলোকে ভেঙে দেয় ডেঙ্গু ভাইরাস। এই কোষগুলো রক্তকে জমাট বাঁধা থেকে আটকায়। প্লেটলেট কমে গেলে তাই শরীরের জায়গায় জায়গায় রক্তক্ষরণ হতে থাকে। মস্তিষ্কে, খাদ্যনালী তে,কিডনিতে, ফুসফুসে রক্তক্ষরণ হলেই জীবনটা শেষ হয়ে যায় ধীরে ধীরে, কিছুই করার থাকে না আর।
প্রতি বছর ডেঙ্গু রোগে কয়েক হাজার মানুষ মারা যান পশ্চিমবঙ্গে আর ভারতবর্ষে। পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। এছাড়াও আছে চিকাঙ্গুনিয়া আর জিকা ভাইরাস। জিকা ভাইরাস ডেঙ্গুর চেয়েও মারাত্মক। গত কয়েক বছর ধরে লাতিন আমেরিকায় বার বার নেমে এসেছে এর কালো ছায়া। এই তিনটে রোগই ছড়ায় খেদির মতো এইডিশ মশারা। খেদিদের মারার জন্য কম চেষ্টাও কিন্তু হয়নি। জমা জল সরানো, মশারি টাঙিয়ে শোয়া থেকে শুরু করে শহরের কোণে কোণে কীটানুনাশক তরল স্প্রে করা বা হেলিকপ্টারে করে গোটা একটা শহরে পেস্টিসাইডের ফোম স্প্রে, সবই হয়েছে। আক্ষরিক অর্থেই যাকে বলে মশা মারতে কামান দাগা।
দুঃখের বিষয় এই যে এত কিছুর পরেও এইডিশ মশাদের বাগে আনা যায়নি। ওরা বেশ ধুরন্ধর, বার বার নিজেদের বদলেছে, বাজার চলতি মশা মারার ওষুধের বিরূদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিটা দিনের সাথে রক্তবীজের মতো বাড়ছে এদের বংশ।
তাহলে উপায়?
বিজ্ঞান তো থেমে নেই। এই মানুষের এক মাত্র অস্ত্র। বিজ্ঞানই এবারে এমন এক দিশা দেখিয়েছে যাতে করে একেবারে গোড়া থেকে এই আগাছাকে উপড়ে ফেলা যায়। সেই অস্ত্রের নাম CRISPR-Cas9। CRISP এর পুরো নামটা বেশ খটমট, Clustered regularly interspaced short palindromic repeats। Cas9 একটা এনজাইমের নাম। কীভাবে কাজ করে এরা?
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কথা অনেকেই শুনেছেন। এতে একটা প্রজাতির জিন আরেকটা প্রজাতির বা একই প্রজাতির দুটো ভিন্ন প্রকারের প্রাণীর জিনের সাথে মিশিয়ে তৈরি হয় নতুন একটা জিন। আজকের যুগে এর অবদান অপরিসীম। জেনেটিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমেই তৈরি করা হয় ইনসুলিন, যা ডায়াবেটিসের চিকিৎসাকেই বদলে দিয়েছে। আবার এই পদ্ধতিতেই শস্য, আনাজপাতির ফলন অনেক বাড়ানো গেছে। মাছ, মুরগীর আকার বড় হয়েছে, তাদের প্রজনন বেড়ে গেছে অনেক। আমরা সারা দিনে কত যে এই পদ্ধতিতে বানানো খাবার খাই তা নিজেরাই জানি না।
CRISPR হল এই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এরই নব তম সংযোজন। এতে দুটো জিনকে একসাথে মেশানো হয় না। একটা জিনের মধ্যেই নিজের ইচ্ছা মতো পরিবর্তন করা যায়।
প্রথমে কাজ করে Cas9 এনজাইম। সার্জিকাল স্ক্যালপেল বা ছুরির মতো এই এনজাইম নিঁখুত ভাবে বাদ দিয়ে দেয় যে কোন জিনের অভীষ্ট অংশ। তারপরে CRISPR সিস্টেমের সাথে থাকা জিনের টুকরোর প্যাকেজ দিয়ে ভরে ফেলা যাবে সেই ফাঁক।
এইডিশ মশার জিনের যে অংশটা ডেঙ্গুর ভাইরাসকে মশার শরীরে বাসা বাঁধতে দেয় সেই জায়গাটুকু CRISPR এর মাধ্যমে বাদ দিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু এর পরেও একটা ছোট্ট মুশকিল থেকেই যায়। ডেঙ্গু, জিকা আর চিকাঙ্গুনিয়ার ভাইরাসকে এইডিসের জিনের তিনটে আলাদা জায়গা প্রশ্রয় দেয়। তাই তিনটে রোগ মুছতে গেলে জিনের তিনটে আলাদা জায়গাকে কাটতে হবে, এর জন্য জিনের মধ্যে যে বদল আসবে তা হয়ত আরো মারাত্মক হতে পারে। বিজ্ঞানীদের তাই অন্য কিছু ভাবতে হয়েছে।
CRISPR-Cas9 এর মাধ্যমে এইডিশের জিনের সেই জায়গাটাকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা এদের প্রজননের জন্য দায়ী। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির মলিকুলার জেনেটিসিস্ট অ্যান্থনি জেমসের এই আবিষ্কার এইডিশ মশার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। CRISPR-Cas9 এর মাধ্যমে বানানো বন্ধ্যা মশাদের ছেড়ে দেওয়া হবে ওদের স্বাভাবিক বসতিতে। এই বদলে ফেলা জিন এবারে ছড়িয়ে যাবে ওদের মধ্যে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় জিন ড্রাইভ। প্রতিটি প্রজননের সাথে সাথে বন্য বা ওয়াইল্ড মশার মধ্যে বাড়তে থাকবে বন্ধ্যা মশার সংখ্যা। একসময় এরাই গোটা জাতটারই দখল নেবে। তারপরে ডেঙ্গু, জিকার ভাইরাস সেই মশাদের শরীর বাসা বাঁধলেও তারা মানুষের আর ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ তারা যে প্রজননের ক্ষমতাই হারিয়েছে! রক্তের প্রয়োজনই নেই আর তাদের!
ব্রাজিলের পুয়ের্তোরিকো শহরে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় কয়েক লক্ষ্য মানুষ। সেখানে ল্যাবরেটরিতে বানানো বন্ধ্যা মশাদের ছাড়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। কিছু আইনি জট কাটলেই হয়ত এটা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে। সফল হলেই এই পদ্ধতিকে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে গোটা বিশ্বে।
ভারতেও CRISPR-Cas9 নিয়ে বেশ ভাল কাজ হচ্ছে। দিল্লীর ইন্সটিউট অফ জিনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড বায়োলজির বিজ্ঞানী দেবজ্যোতি চক্রবর্তী এই পদ্ধতিতে চেষ্টা করছেন সিকল সেল অ্যানিমিয়ার মতো জিন বাহিত রোগকে সারিয়ে তোলার। পৃথিবীর অন্যন্য দেশে মাস্কুলার ডিস্ট্রফি, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, হেপাটাইটিসের মতো রোগেরও চিকিৎসার পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে CRISPR-Cas9 এর মাধ্যমে। আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে গোটা চিকিৎসা বিজ্ঞানই অনেকটা এগিয়ে যাবে এর জন্য। তবে বর্তমানে এর সব চেয়ে বড়ো প্রত্যক্ষ প্রয়োগ হচ্ছে এইডিশ সংক্রামিত মারণ রোগগুলিকে নির্মুল করার জন্য।
মশা মারতে কামান দাগার প্রয়োজন হয়ত আর হবে না। দেশ আর রাজ্যের সরকার যদি আগ্রহ দেখিয়ে এগিয়ে আসেন তাহলে টুক করে একটা জিনের একটুকরো বাদ দিলেই হবে কেল্লা ফতে। খেদিদের খেদানোর জন্য এই টুকুই যথেষ্ট। ডেঙ্গু মুক্ত ভারতবর্ষের স্বপ্ন তাই দেখাই যায়।
তথ্যসূত্র-1. National Geographic Magazine
2. GBD 2015 Disease and Injury Incidence and Prevalence Collaborators. Global, regional, and national incidence, prevalence, and years lived with disability for 310 diseases and injuries, 1990–2015: a systematic analysis for the Global Burden of Disease Study 2015. Lancet 388, 1545–1602 (2016)
3. Arjunan, A. Prevalence of the βeta-S gene and sickle cell disease in India. Univ. Pittsburg (2013) Link
4. Keep off-target effects in focus. Nat. Med. (2018) doi: 10.1038/s41591-018-0150-3