দুইয়ে মিলি করি কাজ

দুইয়ে মিলি করি কাজ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ অক্টোবর, ২০২১

দুজনেরই জন্ম একই বছরে। বেঞ্জামিন লিস্টের জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুটে আর ডেভিড ম্যাকমিলানের স্কটল্যান্ডের ব্রেসিলে। দুজনের কর্মক্ষেত্রও ভিন্ন শহরের ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ম্যাকমিলান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আর লিস্ট জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। শুরুতে লিস্ট জানতেনই না ম্যাকমিলানও একই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। একেই বোধহয় বলে চিন্তার ঐক্য। কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বসেও একই বিষয়ে চিন্তা যদিও এই নতুন নয়। চিন্তার ঐক্যের ক্ষেত্রে পূর্বজ জ্ঞানের সূত্রই প্রধান পাথেয়।
গত শতাব্দী পর্যন্ত ধারণা ছিল দু রকমের অনুঘটক আছে। ধাতব এবং আমাদের শরীরের উৎসেচক যা অনুঘটক। উৎসেচক বা শরীরের জৈব অনুঘটক আসলে জৈব অনু, যা প্রাকৃতিক। প্রকৃতিই অনন্ত কাল ধরে শরীরের মধ্যে এই অনুঘটক তৈরি করে আসছে। আর পৃথক পৃথক ধাতব পরমানুকে একটি বন্দোবস্তের মধ্যে এনে ধাতব অনু বা অনুঘটক গঠন করা যায়। কিন্তু জৈব অনুঘটক গঠনের প্রক্রিয়া জানা ছিল না রসায়নে। দুই বিজ্ঞানীই আলাদা আলাদা ভাবে কৃত্রিম উপায়ে জৈব অনুঘটক তৈরির পথ বাতলে দিয়েছেন নতুন শতাব্দির গোড়াতেই।

বহু গবেষণা ক্ষেত্র, শিল্প ক্ষেত্র রসায়নের এই ধাতব অনুঘটক ও তা জাত অনুঘটন প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে থাকত। যেমন ব্যাটারিতে শক্তি সঞ্চয় করে রাখা, রোগ দমন কারী ওষুধ ইত্যাদি। এই কাজ গুলির জন্যে দরকার হয় অনুঘটকের। এ আবিষ্কারের আগে ভারি ধাতু দিয়ে গঠিত ধাতব অনুঘটক দিয়ে বিক্রিয়া ঘটানোর পদ্ধতির পরিবেশগত প্রভাব ছিল অনেক বেশিই,সাথে ধাতু যেহেতু বাতাসের আর্দ্রতা ও অক্সিজেনর সংস্পর্শে এলেই বিক্রিয়া ঘটিয়ে চাওয়ার উল্টো কোনো বস্তুতে পরিনত হয়, তাই প্রয়োজনীয় রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে দিতো না বাতাসে আর্দ্রতা ও অক্সিজেনের উপস্থিতি। তাই ধাতব অনুঘটকের ক্ষেত্রে বিক্রিয়ার গতি নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। অথচ মজার ব্যাপার শরীরের যে উৎসেচক জনিত জৈব অনুঘটক তাদের বিক্রিয়ায় আর্দ্রতা বা অক্সিজেন প্রভাব ফেলতে পারে না।

দুজনেই আলাদা আলাদা ভাবে খুঁজছিলেন সেই পথ, যাতে দুটি জৈব অনুর মধ্যে জোড় বাঁধিয়ে ইচ্ছে মতো গতি বাড়িয়ে কমিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে সম্পন্ন করা যায়। লিস্ট এবং ম্যাকমিলানের দেখানো জৈব অনুঘটক উৎসেচকের সমান দক্ষতায় কাজ করতে পারে। এবং বিক্রিয়ার ধাপ কমিয়ে মাঝের ধাপ গুলিতে উৎপন্ন অপ্রয়োজনীয় জৈব অনুগুলি তৈরি না হতে দিয়ে, বিক্রিয়া ঘটিয়ে যে জৈব অনু চাইছি সেগুলিই বেশি করে পাওয়া যেতে পারে। এতে অনেক রকম উপকার – খরচ বাঁচে। পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক উপজাত তৈরি কম হয়। আর ওষুধ তৈরিতে এর উপযোগিতা ভয়ানক। নিখুঁত জৈব অনু গঠিত হয় ওষুধের ভেতরে। যার ফলে ওষুধ খেলে সাইড এফেক্টের সম্ভাবনা কমে।
তবে লিস্ট ও ম্যাকমিলানের দেখানো জৈব অনু ধাতব অনুঘটকের চেয়ে তো আলাদাই এমনকি শরীরের জৈব অনুঘটক বা উৎসেচকের মতোও নয়। দুই বিজ্ঞানীর দেখানো এই জৈব অনুঘটক বা আসলে কার্বন পরমানুর জৈব যৌগ বা অনু। যাতে থাকে অক্সিজেন পরমানু হাইড্রোজেন পরমানু, নাইট্রোজেন পরমানু ইত্যাদি।
ম্যাকমিলানই নতুন অনুঘটকের প্রথম নাম দেন – অরগ্যানোক্যাটালিস্ট এবং যে প্রক্রিয়ায় জৈব অনুঘটক গঠন সম্ভব সে প্রক্রিয়ার নাম – অরগ্যানোক্যাটালেসিস।
বেঞ্জামিন গোড়াতে ভাবতেন এভাবে ভাবা বুঝি বোকামি হচ্ছে। সেই বোকামিই পরিবেশ বান্ধব পথ দেখালো রসায়নবিজ্ঞানে। আবিষ্কারের কুড়ি বছর পর পৃথিবীখ্যাত সম্মান নোবেল এনে দিল হটকে ভাবনা। নেহাত বোকামি কি? চলতি জ্ঞানের সূত্র ধরে নতুন জ্ঞানের সন্ধান। বিজ্ঞানের গতির চাবিকাঠি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + 12 =