পাগলামিও একটা রোগ

পাগলামিও একটা রোগ

অভীক ভট্টাচার্য্য
Posted on ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১

হ্যাঁ, পাগলামিও একটা রোগ…….

♣ রোগ কী?
→সহজ কথায় বললে রোগ হল শরীরের এমন এক পরিবর্তিত পরিস্থিতি যা একজন মানুষের দৈনন্দিন কাজের ব্যাঘাত ঘটায়। কিন্তু এখানেই একটা বড় ফাঁক রয়ে গেল , শরীর বলতে আমরা বোধহয় কেবল এই রক্ত-মাংসের পশু টাকেই বুঝি। যার বদান্যতায় আমরা মানুষ তকমা নিয়ে বেশ একটা অহংকারের সাথে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াই ,সেই মন আর ব্যক্তিত্বের কথা বেমালুম ভুলে যাই। মেজাজ-ব্যক্তিত্ব-মন এরাও যে বিগড়োতে পারে সেটা একটা উন্মাদকে দেখে বোঝা খুব একটা কঠিন নয়। আমরা আবার এদের দেখে বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে হাসাহাসি করতেও পিছপা হ্ইনা–এটা দেখে আমার আরও অদ্ভুত লাগে। ওরা তো সঙ্গত কারণেই রোগী, আর আমরা নিজেরা বোধহয় আরও বেশি মানসিক ভাবে অসুস্থ।একজন অসুস্থ মানুষকে দেখে যদি কারোর হাসি পায়, তাহলে তাকে কি সুস্থ বলা যায়? প্রশ্নটা আপনাদের জন্য। তাই ওদের সাথে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সহানুভূতির সাথে মিশতে চেষ্টা করুন।

♣ মানসিক সমস্যা কেন একটা রোগ?
→ একদিন একটু ঠাণ্ডা লেগে দুবার হাঁচি হলেই কি সেটা রোগ? না, সেটা রোগ না।কিন্তু যদি সেটা বারবার দীর্ঘদিন ধরে হয় বা জ্বর থাকে ,তখন সেটা রোগ। তেমনই একদিন মেজাজ বিগড়ে যাওয়া বা কোন সঙ্গত কারণে দুঃখ পাওয়া( যেমন–কোন নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ) বা হতাশ হ্ওয়াটা রোগ নয়, কিন্তু দীর্ঘদিন ( অন্তত একটানা দিন-পনেরো) যদি মেজাজ বিগড়ে থাকে বা কোন্ও কাজে উৎসাহ না পান বা কোন কাজে মনোঃসংযোগ করতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনার মানসিক রোগ হয়েছে।
রক্তে শর্করার মাত্রার যেমন একটা স্বাভাবিক সীমা রয়েছে আর সেটার থেকে কম বা বেশি হলে যেমন রোগ‌ ( ব্লাড-সুগার বা ডায়াবেটিস মেল্লিটাস) হয়, তেমনই মস্তিষ্কেও সেরোটোনিন, ডোপামিন ইত্যাদি বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের ( যারা আপনার চিন্তা-ভাবনা বা কোন অনুভূতি বা মস্তিষ্ক কর্তৃক প্ররিত কোন সংকেতের পরিবহনে ও সংযোগে সহায়তা করে) ভারসাম্য বিঘ্নিত হলেই মানসিক রোগ হয়।
আপনার মনে ঠিক কতটা আনন্দ হবে সেটা ঠিক করে দেয় আপনার মস্তিষ্কে ঠিক কতটা সেরোটোনিন নিঃসরণ হল। আপনি ঠিক কতটা চনমনে থাকবেন সেটা ঠিক করে দেয় ডোপামিন।
কেন এটা রোগ সেটা আশাকরি বুঝতে পেরেছেন তাই সর্বপ্রথম রোগী এবং রোগীর পরিবারের সদস্যদের বোঝা উচিত যে একজন শারীরিক ভাবে সুস্থ হলেও, মানসিক ভাবে সে অসুস্থ হতে পারে এবং যত শীঘ্র সম্ভব তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি।

♣ মানসিক রোগ কেন হয়?
→ আপনি দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান করছেন, লাগামছাড়া ফার্ষ্টফুড খাচ্ছেন, কোনরকম শারীরিক পরিশ্রম করছেন না, তারফলে যেমন আপনার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় বা আপনার রক্তচাপ বাড়তে থাকে, তেমনই দীর্ঘদিন ধরে আপনার মন তথা ব্যক্তিত্বের ওপর যে অত্যাচার-অনাচার হয়ে আসছে তার ফলস্বরূপ্ই এই মানসিক রোগ।
আমাদের মন তথা চেতনার মূলত তিনটি স্তর রয়েছে–সচেতন,অর্ধচেতন আর অবচেতন। সচেতন বলতে যে মানসিক পরিস্থিতিতে আমরা অধিকাংশ দৈনন্দিন কাজ করি, নিকট অতীতে করা কাজের স্মৃতি তথা অভিজ্ঞতা জমা থাকে অর্ধচেতনে আর তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সচেতনভাবে করা বর্তমানের কাজগুলোকে প্রভাবিত করে। আর অবচেতন মন হল একটা অসীম স্থান যেখানে আমরা গভীর ঘুমের মধ্যে একাকী হেঁটে বেড়াই। জন্ম থেকে ঘটে চলা সমস্ত ঘটনা, আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা, অপমান, আশা- আকাঙ্খা সবকিছুই জমা থাকে এই অবচেতনে। এটা প্রত্যক্ষভাবে হয়তো সচেতন মনকে প্রভাবিত করে না, কিন্তু পরোক্ষভাবে এটাই সেই মানুষটার ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আমাদের মনের ওপর বাইরের সমাজের অত্যাচার- অবিচারের ওপর আমাদের খুব একটা নিয়ন্ত্রণ নেই কিন্তু সেই পরিস্থিতিকে আমরা কিরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছি আর কেমন প্রত্যুত্তর দিচ্ছি সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটা পুকুরের পাঁক পচতে আরম্ভ করলে প্রথমে কিছু বোঝা যায়না, বিশাল পরিমাণ জলে লঘু হয়ে যায়, কিন্তু যখন অনেকটা পচে যায় তখন জলের রঙটাও পাল্টায় আর ওপর থেকেই সেই দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। তাই অবচেতনের ফাঁকা স্থানটাকে যদি আমরা কেবল ডাস্টবিনের মতো রাগ-অপমান-অভিমান-ক্ষোভ, প্রত্যাশা এসব দিয়ে ভর্তি করতে থাকি, তাহলে সেই অবচেতনের দুর্গন্ধ একদিন সচেতন মনের দেউড়িতেও ভেসে আসবে আর মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলবে।

♣ মানসিক রোগ কয়প্রকার?
→এটা নিয়ে খুব সংক্ষেপে বলছি, কারন এটা চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটা বিরাট শাখা, তাই আমার কাছে তো বটেই, চিকিৎসকমহলের কাছেও ঝাপসা ও সদা পরিবর্তনশীল। মূলত মানসিক সমস্যাকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—-সাইকোসিস( Schizophrenia, hallucination, delutions etc) আর নিউরোসিস( mood disorders—Major depressive disorder, chronic depressive disorder, mania, Bipolar disorder, Rapid cycler , OCRD–obsession, compulsion and related disorder, Anxiety disorder etc.)
এছাড়াও আরো অনেক আছে যেমন এ.ডি.এইচ.ডি, অ্যালকোহল আর ড্রাগ রিলেটেড ডিসর্ডার ইত্যাদি ইত্যাদি।

♣ মানসিক রোগ প্রতিরোধের উপায়?
→শরীরকে যেমন ভালো সুষম পুষ্টিকর খাবার দিলে তার সুসমঞ্জস বৃদ্ধি হয়, তেমনই মনের খাবার হচ্ছে ভালো চিন্তা, সৎ চিন্তা, ভালো কাজ, নিঃস্বার্থ কাজ, পরোপকার। এগুলো করলে আর হিংসা-বিদ্বেষ কমিয়ে ফেললে দেখবেন এমনিই মনটা কেমন হালকা, ফুরফুরে আর খুশি খুশি থাকবে কেননা এরা সেরোটোনিন নিঃসরণ বাড়ায়।
যত নিজের রাগকে সংযত রাখবেন, যত অপরকে ক্ষমা করে দিতে পারবেন, যত সরলভাবে সত্যকে ধরে চলবেন তত আপনার মন ভালো থাকবে। অবচেতনেও স্বচ্ছ জল টলমল করবে। বলা যতটা সহজ, করা ততটা সহজ না একদমই, যখন কেউ আপনাকে অপমান করে বা দোষারোপ করে তখন মুখ বুজে সহ্য করা বেশ কঠিন। তখন ভাবতে চেষ্টা করতে পারেন, উল্টোদিকের যে মানুষটা রাগ দেখাচ্ছে সে আসলে তার নিজের আবেগ-অনুভূতির কাছে দুর্বল আর অসহায়, তাই রাগ দেখিয়ে তার অসহায়তা, নিরাপত্তাহীনতাকে প্রকাশ করছে‌। আপনি যদি মানসিক দিক দিয়ে তার থেকে শক্তিশালী হন, তবেই তার কথাগুলো মুখ বুজে সহ্য করতে পারবেন এবং যুক্তি দিয়ে বিচার করে তার যথার্থ প্রত্যুত্তর দেবেন কিন্তু শুধুমাত্র নিজের আবেগ বা সাময়িক উদ্দীপনার দাস হবেন না।
একটা বয়সের পর রাতের ঘুম নিয়েও কিছুটা সচেতন‌ হতে হবে, কেননা ঘুম খুবই প্রয়োজনীয় একটা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যেটা মানুষের সারাদিনের সমস্ত পরিশ্রমের ক্লান্তি মুছে দিয়ে নতুন শারীরিক ও মানসিক শক্তি ভরে দেয়। ঘুমের মধ্যে মানুষ সারাদিনের কাজগুলো একবার ঝালিয়ে নেয়, তাই স্মৃতি শক্তি ঠিক রাখার জন্য ও মানসিক চাপ কমাতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ( ৭-৮ ঘন্টা) নিরবিচ্ছিন্ন ঘুমের খুব প্রয়োজন। যাদের রাতে ঘুমের সমস্যা আছে তারা কিছু অভ্যাস ( Sleep hygiene) করতে পারেন যাতে ঘুম ভালো হয়, যেমন—-
১. দিনে ঘুমোবেন না সময় পেলেও
২. কিছু শারীরিক পরিশ্রম করুন যাতে আপনার শরীরে ক্লান্তি আসে–প্রয়োজনে রাতে খাবার পর পরিবারের সকলে মিলে বা বন্ধুরা মিলে কিছুটা হেঁটে আসুন, এতে শরীর ও মন দুইই ভালো থাকবে
৩. রাতে শোয়ার আগে স্মার্টফোনের ব্যবহার কমিয়ে দিন, স্ক্রিনের নীল আলো ঘুম কমিয়ে দেয়।
৪. রাতে শোয়ার আগে কিছু ভালো ধীরলয়ের গান শুনুন।
৫.নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান।
এরপরও যদি আপনার ঘুমের সমস্যা না মেটে তাহলে মনোবিদের কাছে যান এবং তার পরামর্শমতো ওষুধ খান, এখন ঘুম ঠিক করার অনেক ভালো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন ওষুধ বেরিয়েছে ( Z drugs–Eszopiclone, Zolpidem etc.)।
প্রতিদিন নিয়ম করে একটা সময় যাহোক কিছু শরীরচর্চা করুন, যত ব্যস্ততাই থাক ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১/২ ঘন্টা সময় বার করাই যায়, তাই নিজের কাছে ফালতু অজুহাত দেওয়া ছেড়ে ওটাকে দিনের চান-খাওয়ার মতো অত্যাবশ্যকীয় একটা অভ্যাসে পরিণত করুন। মন ভালো রাখার প্রথম শর্ত্ই হল শরীরকে ভালো রাখা, শরীর খারাপ থাকলেই আপনাকে কর্মক্ষেত্র থেকে নির্বাসনে একা একা থাকতে হবে, এই অপ্রয়োজনীয় বিরতির একাকিত্ব থেকেই অনেক সময় মানসিক রোগের জন্ম নেয়।
একটা কথা আছে, ‘the more you make it strong, it obeys; the more you make it weak, it commands’, তাই নিজের শরীরকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করুন।
নিজের চারদিকে অযথা একটা আত্মমর্যাদা বা আত্ম্অহংকারের প্রাচীর তুলে রাখবেন না, মানুষের সাথে খোলা মনে মিশুন, নিজের থেকেই কথা বলার চেষ্টা করুন, মনের দরজা-জানালা খোলা রাখুন, সেখানে একটু উত্তাপ, ঝড়-ঝঞ্ঝা সবকিছুকেই ঢোকার জায়গা দিন।প্রতিটা মানুষের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শেখার আছে, তাই কাউকে ছোট না করে সবার সাথে মিশুন।
এসবের পরেও যদি আপনার মেজাজ বিগড়োয় বা মনোনিবেশের সমস্যা হয়, তাহলেও নিজেকে দোষী ভাবার কোনো কারণ নেই, কারন সকল মানুষের মানসিক গঠন তো আর এক হয়না, তাই অতি অবশ্যই যত শীঘ্র সম্ভব মনোবিদের সাথে যোগাযোগ করুন, তার কথামতো ওষুধ খান। আপনার মানসিকরোগ হয়েছে কারণ ছোট থেকে আপনার মানসিক গঠন ঠিক হয়নি বা আপনার জীবনের ‌কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার‌ প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি অপ্রতুল, তাই সেটাকে ঠিক করার কাজ কিন্তু নিজেকেই নিতে হবে, আর ভালো অভ্যাসগুলো গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
মনোবিদরা সাময়িক আপনাকে সাহায্য করতে পারেন কিছুটা, আর কিছুইনা কিন্তু।
বর্তমানে মানসিক রোগের চিকিৎসারও একটা বড়ো অংশ্ই হল কাউন্সেলিং বা কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি( Cognitive behavioural therapy)। যেটা অনেক রকমের হতে পারে, যেমন–যদি কুকুরে ভয় থাকে তো তাকে বেশি করে কুকুর দেখানো, মানুষের সাথে কথা বলা, সর্বোপরি নিজের ফাঁকা সময়টাকে একটা নির্দিষ্ট পছন্দসই গঠনমূলক কাজে ভরিয়ে রাখা।
সবশেষে বলি মানসিক সমস্যাও একটা রোগ, সেটা সমাজের প্রতিটা মানুষকে স্বীকার করতে হবে এবং একটা রোগীর জন্য যা যা করনীয় তাই তাই করতে হবে অত্যন্ত সহানুভূতির সাথে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির দৌলতে রক্ত-মাংসের মানুষের পরমায়ু আজ ৮ এর ঘর ছুঁই ছুঁই, সাথে যদি এই শারীরিক ভাবে সুস্থ মানসিক রোগীদের জীবনের মূলস্রোতে ফেরানো যায় তাহলে বোধহয় একটা বিরাট পরিমাণ অব্যবহৃত মানবসম্পদের সদ্ব্যবহার হবে, যেটা সমাজকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

* লেখক মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের সিনিয়ার স্কলার।