
এমন কোন প্রাণীর কি অস্তিত্ব আছে যার দেহে আঘাত হেনে রক্তপাত ঘটালে, সেই রক্তে উপস্থিত কোন বিশেষ উদ্বায়ী পদার্থ সঙ্গে সঙ্গে বাষ্পে রূপান্তরিত হয়ে আক্রমণকারীর স্নায়ুতন্ত্রে অস্বস্তি সৃষ্টি করে ! ফলে আক্রমণকারী প্রাণীটিকে আরও আঘাত করা থেকে বিরত হয় ! বর্তমানে কেবল কল্পবিজ্ঞানেই এমন প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয়, তবে বাস্তবে অনেকটা এই ধরনেরই একটি উদ্ভিদ রয়েছে। এই উদ্ভিদের ফল যে কোন ঝাল মশলাদার স্বাদে এক নান্দনিক গভীরতা ও মিষ্টতা প্রদান করে – পেঁয়াজ !
যে মাটিতে সালফার যথেষ্ট পরিমাণে মিশে থাকে, সেই মাটিতে পেঁয়াজের ফলন খুব ভালো হয় কারণ পেঁয়াজ-উদ্ভিদের স্বভাবই হলো মাটি থেকে বেশী পরিমাণে সালফার শোষণ করে নিজের দেহে একটি প্রতিরক্ষাতন্ত্র গড়ে তোলা। এই প্রতিরক্ষাতন্ত্রের উপাংশগুলি হলো – ‘অ্যালিআইনেজ’ নামক উৎসেচক, ‘ল্যাক্রিমেটরি-ফ্যাক্টর সিন্থেজ’ নামক উৎসেচক, এবং কতগুলি অ্যামাইনো অ্যাসিড সালফক্সাইড যেগুলি পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ-উদ্ভিদের কোষগুলিতে সঞ্চিত থাকে। পেঁয়াজ-উদ্ভিদ আসলে মাটি থেকে সালফার শোষণ করে সেই সালফার দিয়েই অ্যামাইনো অ্যাসিড সালফক্সাইডগুলি তৈরি করে। কোন পোকা-মাকড় পেঁয়াজ বা পেঁয়াজ-উদ্ভিদের কোন কলাস্তরকে কাটলে সেই কলাস্তরের কলায় উপস্থিত কিছু কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সেই কোষগুলিতে সঞ্চিত থাকা অ্যালিআইনেজ উৎসেচক, ল্যাক্রিমেটরি-ফ্যাক্টর সিন্থেজ উৎসেচক, এবং অ্যামাইনো অ্যাসিড সালফক্সাইডগুলি ক্ষরিত হতে থাকে। ক্ষরিত হওয়ার সময়ে অ্যালিআইনেজ উৎসেচক অ্যামাইনো অ্যাসিড সালফক্সাইডগুলিকে বিশ্লিষ্ট করে সালফ্যানিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে। সালফ্যানিক অ্যাসিড হলো খুবই অস্থায়ী এক যৌগিক পদার্থ। সালফ্যানিক অ্যাসিডের অণু ল্যাক্রিমেটরি-ফ্যাক্টর সিন্থেজ উৎসেচকের প্রভাবে পুর্নগঠিত হয়ে ‘সিন-প্রোপেনথিয়াল এস্-অক্সাইড’ নামক এক উদ্বায়ী যৌগিক পদার্থের অণু তৈরি হয়। সিন-প্রোপেনথিয়াল এস্-অক্সাইড উদ্বায়ী বলে উৎপন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাষ্পে রূপান্তরিত হয়ে আক্রমণকারী পোকা-মাকড়ের মধ্যে স্নায়বিক অস্বস্তি সৃষ্টি করে। ফলে পোকা বা মাকড়টি পেঁয়াজ বা পেঁয়াজ-উদ্ভিদের কলাস্তরে আর কামড় না বসিয়ে পালিয়ে যায়।
আমরা পেঁয়াজ কাটার সময়েও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। সিন-প্রোপেনথিয়াল এস্-অক্সাইড বাষ্প আসলে জলে দ্রাব্য ও জলে দ্রবীভূত হলেই এটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাই আমরা পেঁয়াজ কাটার সময়ে এই বাষ্প উৎপন্ন হয়ে আমাদের চোখে উপস্থিত সেন্সরি বা সংবেদনজ স্নায়ুকোষগুলিতে অস্বস্তি উৎপাদন করলেই এই বাষ্পের কার্যকারিতাকে কমানোর জন্য আমাদের স্নায়ুতন্ত্র আমাদের চোখে উপস্থিত সংবেদনজ স্নায়ুকোষগুলির মাধ্যমেই চোখের অশ্রুগ্রন্থিগুলিকে অশ্রু বিসর্জন করার নির্দেশ দেয়। ফলে পেঁয়াজ কাটার সময়ে কাঁদার কোন কারণ না থাকলেও আমরা চোখের জল ফেলতে থাকি!
চোখের জলে চোখ ঝাপসা হয়ে যায় বলে পেঁয়াজ কাটার সময়ে হাত কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ! চোখে যাতে জল না আসে সেইজন্য কিছু বিশেষ পন্থা আমরা অবলম্বন করতে পারি।
পেঁয়াজ কাটার সময়ে মাথার উপর বা কাছাকাছি পাখা চলিয়ে রাখলে উৎপন্ন হওয়া সিন-প্রোপেনথিয়াল এস্-অক্সাইড বাষ্প অপসারিত হয়ে যায়, তা আমাদের চোখ পর্যন্ত সহজে পৌঁছতে পারে না।
পেঁয়াজ কাটার আগে পেঁয়াজগুলিকে কয়েক মিনিটের জন্য ফ্রিজ বা ফ্রিজারে ঠান্ডা করে নেওয়া যেতে পারে। পেঁয়াজ কাটার সময়ে উৎপন্ন হওয়া উদ্বায়ী সিন-প্রোপেনথিয়াল এস্-অক্সাইড পেঁয়াজ থেকেই লীনতাপ শোষণ করে বাষ্পে রূপান্তরিত হয়। পেঁয়াজ ঠান্ডা হলে লীনতাপের অভাবে সিন-প্রোপেনথিয়াল এস্-অক্সাইড বাষ্পে পরিণত হতে পারে না। তাই এটি আমাদের চোখ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।
পেঁয়াজ কাটার আগে পেঁয়াজকে কিছুক্ষণ জলে ডুবিয়ে রাখলে পেঁয়াজের কোষগুলিতে সঞ্চিত থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিড সালফক্সাইডগুলি জলে দ্রবীভূত হয়ে পেঁয়াজের কোষ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ফলে সেই পেঁয়াজকে কাটার সময়ে সিন-প্রোপেনথিয়াল এস্-অক্সাইড উৎপন্ন হয় না।
আপনি যদি ‘অনিয়ন গগল্স’ নামক পেঁয়াজ কাটার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ চশমা ব্যবহার করেন, তাহলে অন্য কোন পন্থা নিয়ে ভাবার প্রয়োজনই নেই। অনিয়ন গগল্স আপনার দেখায় কোন অসুবিধা সৃষ্টি করবে না কিন্তু আপনার চোখদুটিকে ঢেকে রেখে সিন-প্রোপেনথিয়াল এস্-অক্সাইড বাষ্পকে আপনার চোখ পর্যন্ত পৌঁছতে দেবে না।