প্রশ্নের মুখে মহাবিশ্বের মান্য মডেল

প্রশ্নের মুখে মহাবিশ্বের মান্য মডেল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৮ জুন, ২০২৫

মহাজাগতিক পটভূমি থেকে আগত বিকিরনের রেশ বিগ ব্যাং তত্ত্বের সপক্ষে সবচেয়ে বড়ো সূত্র। কিন্তু এতদিন পর বন, প্রাগ আর নানজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই বহুপরিচিত ধারণাটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-বি পত্রিকায় তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্বতত্ত্বর মান্য মডেল অনুযায়ী মহাবিশ্বর সূত্রপাত হয় ১৩.৬ বিলিয়ন বছর আগে এক অতি প্রকাণ্ড বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। তারপর ফেটে বেরিয়ে আসে দেশ, কাল আর পদার্থ, দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে মহাবিশ্ব। প্রথম ৩ লক্ষ ৮০ হাজার বছরের মধ্যে মহাবিশ্ব এতটাই ঠাণ্ডা হয়ে ওঠে যে ইলেকট্রন আর প্রোটন কণারা মিলে চার্জহীন হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি হয়। আলো সেই প্রথম অবাধে দেশের মধ্য দিয়ে চলতে পারল, কারণ প্রোটনরা আর বস্তুর সঙ্গে সদাসর্বদা আন্তঃক্রিয়া ঘটাচ্ছিল না। ওই মুহূর্তটাকেই মহাজাগতিক পটভূমি থেকে আগত বিকিরণের জন্মমুহূর্ত বলা চলে। ওটিই মহাবিশ্বের সেই আদি আলোক যাকে অতি-সংবেদি দূরবীক্ষণ সহযোগে আজও শনাক্ত করা যায়।

যেহেতু ওই বিকিরণ প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন ধরে চলে আসছে তাই মহাবিশ্বর জন্মমুহূর্তের ঠিক পরের কয়েক ঘণ্টায় কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে তা থেকে একটা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা যায়। কিন্তু একজন গবেষকের হিসেব অনুযায়ী এমনও হতে পারে যে ওই বিকিরণের কোনো অস্তিত্ব আদপেই নেই। অন্তত এটুকু নিশ্চিত যে আগের হিসেবে বিকিরণের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। দুই গবেষক উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণা করেন। বিগ ব্যাঙের পর থেকেই ফুলন্ত রুটির মতো প্রসারিত হয়ে চলেছে মহাবিশ্ব। অর্থাৎ গ্যালাক্সিদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলো আজ একে অপরের থেকে কত দূরে রয়েছে তা হিসেব করে বার করেছেন তাঁরা। প্রসারণের গতিকে কাজে লাগিয়ে এখন তাঁরা হিসেব করে বলতে পারছেন ওরা কখন সৃষ্ট হয়েছিল। আগেই জানা ছিল, মহাবিশ্বের তরুণ বয়সে এই উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলোই প্রথম জন্ম নিয়েছিল। অতি বিপুল পরিমাণ গ্যাস জমে উঠে শত শত কোটি নক্ষত্র তৈরি হয়, যারা এই গ্যালাক্সিগুলো গড়ে তোলে। কিন্তু এখনকার গবেষণার ফল থেকে দেখা যাচ্ছে এই গোটা প্রক্রিয়াটা ঘটতে সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক শো মিলিয়ন বছর – যা মহাবিশ্বতাত্ত্বিক মানদণ্ডে বেশ কম সময়। আর সেই সময় জুড়ে জ্বলন্ত নক্ষত্রগুলোতে পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে তারা এত উজ্জ্বলভাবে দাউ দাউ করে জ্বলছিল যে আজও আমরা তাদের শনাক্ত করতে পারছি। এখনকার হিসেব বলছে, মহাবিশ্বের পটভূমি থেকে আসা বিকিরণের অন্তত কিছুটার উৎস ছিল এই উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলোর গড়ে ওঠা। মোট বিকিরণের ১.৪% তো বটেই, এমনকী সমস্তটার জন্যও এটা দায়ী হতে পারে। গত কয়েক দশকের মাপজোক থেকে দেখা গেছে ওই বিকিরণ সর্বত্র সমান নয়। পর্যবেক্ষণের দিক বিচার করে গবেষকরা বলেছেন বিগ ব্যাঙের পরে গ্যাস যে সমানভাবে বণ্টিত হয়নি, এ হল তারই প্রমাণ। কোনো কোনো অঞ্চলে তার ঘনত্ব অন্য অঞ্চলের তুলনায় সামান্য কম ছিল। বেশি ঘন অঞ্চলগুলো ঘনীভবনের কেন্দ্র রূপে কাজ করেছিল। গ্যাস সেখানে নিজের অভিকর্ষের ভারে সংকুচিত হয়ে গিয়ে নক্ষত্রে পরিণত হয়েছিল। গ্যাসের এই অসম বণ্টন ছাড়া সম্ভবত আমাদেরও অস্তিত্ব থাকত না।

তবে পটভূমি থেকে আগত বিকিরণের যে-হেরফেরের ভিত্তিতে এই নতুন তত্ত্ব নির্মিত, সেটা কিন্তু এক শতাংশ বিন্দুর কয়েক হাজার ভাগ। প্রশ্ন উঠেছে, উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলো যদি মোট মাপ-করা বিকিরণের অন্তত ১.৪%-এর জন্য দায়ী হয় তাহলে এই মাপজোক কতটা নিখুঁত? উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলো নিজেরাই তো সমভাবে বণ্টিত নয়।

গবেষকরা অবশ্য বলছেন, তাঁদের গবেষণার ফলে বিশ্বতত্ত্বর ইতিহাস নতুনভাবে লিখতে হতে পারে, অন্তত আংশিকভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × one =