ফিনিয়াস গেজ ও একটি ট্যাম্পিং রড

ফিনিয়াস গেজ ও একটি ট্যাম্পিং রড

সুপ্রতিম চৌধুরী
Posted on ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১

সেপ্টেম্বর ১৩, ১৮৪৮
ক্যাভেন্ডিশ, ভার্মন্ট

রাটল্যাণ্ড অ্যাণ্ড বার্লিংটন রেইলরোড কোম্পানীর কাজ চলছে। রেলগাড়িতে সওয়ার হয়ে এদেশে বিপ্লব ও প্রগতি আসতে চলেছে খুব শীঘ্র। তারই তোড়জোড় চলছে। খাটনি অনেক। রেল লাইন পাতা তো আছেই। কিন্তু তার আগে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আছে। সেটা হল বড় বড় পাথর ভেঙে সেই জায়গায় রেলসড়ক পাতার ব্যবস্থা করা। সেই কাজ সময়সাপেক্ষ হলেও বারুদের কল্যাণে শ্রমসাপেক্ষ নয়।
এই ‘বিষ্ফোরক’ কাজের দায়িত্ত্ব অবশ্য ‘ফোরম্যান’-এর। শুনে সোজা মনে হলেও, এ কাজে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রাথমিক কর্তব্য। সবার আগে পাথরের ভিতরে একটা গভীর ফুটো করে তাতে বারুদ ভরতে হয়। তারপর তাতে অগ্নিসংযোগের জন্য একটা ‘ফিউজ’ লাগাতে হয়। এবার সেগুলোর উপর বালিচাপা দেওয়া আবশ্যক, যাতে ভিতরের বারুদ কোন স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে এসে দুর্ঘটনা না ঘটায়। সবশেষে একটা ‘ট্যাম্পিং রড’-এর সাহায্যে বিষ্ফোরক পদার্থটি চেপে দেওয়া হয়।
ঠিক এই কাজটাই এক যুবক এই দুপুরবেলায় করে চলেছে। তার নাম ফিনিয়াস গেজ। বয়স অল্প হলেও মাত্র কয়েক বছরেই সে বেশ অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। ঊর্ধতন কর্মচারীদের বাহবাও আদায় করেছে। হাতে একটা প্রায় এক মিটার লম্বা, ছ’কেজি ওজনের ‘ট্যাম্পিং রড’ নিয়ে সে একটা পাথরে বারুদ বাঁধছে। একঘেঁয়েমি কাটাতে পাশের বন্ধুর সাথে গল্প করতে করতে সে যে বারুদের স্তূপের উপরে বালি দিতে ভুলে গিয়েছে, তা খেয়ালই করেনি। সোজা বারুদের উপর রড দিয়ে সে একটা ঘা দিল।
হঠাৎ একটা প্রচণ্ড বিষ্ফোরণে চারপাশ কেঁপে উঠল। সবাই ভয় পেয়ে শব্দ অনুসরণ করে তাকাতেই দেখে ফিনিয়াস গেজ মাটিতে মাথা হেঁট করে বসে আছে। তার কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। ‘ট্যাম্পিং রড’-টা কয়েক গজ দূরে রক্তমাখা অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
সামনে যেতেই এক বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়ল। ফিনিয়াসের বাঁ দিকের গালে আর মাথায় একটা গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে। রডটি তার গালের হাড় ভেঙে ঢুকে, বাঁ চোখটি নষ্ট করে, মাথা ফুঁড়ে বেরিয়েছে। সে যে বেঁচে আছে, সেটাই আশ্চর্যের। এর থেকেও বড় বিস্ময় বাকি ছিল। আতঙ্কিত সবাইকে তাক লাগিয়ে, ফিনিয়াস উঠে বসে জানাল সে ডাক্তারখানায় যাবে।
ডাক্তারখানায় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায় তার কোন স্মৃতিভ্রংশ হয়নি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজন – সকলকেই সে চিনতে পারছে। শুধু তাই নয়, ফিনিয়াস জানায় একটু সুস্থ হয়েই সে আবার কাজে ফিরতে চায়। চিকিৎসাশাস্ত্রে এহেন অদ্ভুত ঘটনা বিরল। ডাক্তারও কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পান না।
কিন্তু এর কিছুদিন পরে আঘাতের ফলস্বরূপ ফিনিয়াস সংজ্ঞাহীন হয়। সে একটা ‘কোমাটোস’ অবস্থায় চলে যায়। ডাক্তার ভাবেন, এই হয়ত শেষ। কিন্তু আবারও মির‍্যাকল ঘটে।

দশদিন ঘোরের মধ্যে থাকার পর ফিনিয়াস গেজের সংজ্ঞা ফিরে আসে। তার স্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। কিছু সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পরে সে ছাড়া পায় এবং আবার নিজের পুরনো কাজে ফিরে যায়। এখানেই আসল গল্পের শুরু। সব ঘটনাই যে প্রামাণ্য, তা নাও হতে পারে।
এই দুর্ঘটনার ফলে ফিনিয়াস গেজের ব্যক্তিত্ব পরিবর্তিত হয় বলে দাবী করেন তার তত্ত্বাবধানে থাকা ডাক্তার জন হার্লো। ফিনিয়াস যে কর্মদক্ষ এবং লোকপ্রিয় ছিল, তা আগেই বলেছি। কিন্তু দুর্ঘটনার পরবর্তী কালে সেই ফোরম্যানের চাকরি থেকেই তাকে বরখাস্ত করা হয়। সে যে কাজ করতে পারত না, তা নয়। কিন্তু কথিত আছে, তার আগের মার্জিত স্বভাব চলে গিয়ে সেই জায়গায় এক অভদ্র, কটুভাষী স্বভাব আসে। সেই কারণেই তাকে চাকরিতে বহাল রাখা অসম্ভব হয়।
ডাক্তার হার্লোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, কেউ ফিনিয়াস গেজের ইচ্ছাবিরোধী কোন উপদেশ দিলে, গেজ তা নিতে পারত না। কোন কাজে মনস্থির করার পর, কাজটা সম্পূর্ণ করার অভিপ্রায়ে সে খাটত ঠিকই। কিন্তু সব ঠিক হওয়ার পরেও, হঠাৎ সবকিছু থেকে সরে আসত।
এক কথায়, তার মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়ে যায়। তাকে যারা চিনত, তারা বলত সে আর আগের গেজ নেই।
ডাক্তার হার্লো মনে করেন, গেজের মস্তিষ্কের ‘ফ্রন্টাল লোব’ আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণেই তার ব্যক্তিত্ত্বের এই পরিবর্তন ঘটে। এই ‘ফ্রন্টাল লোব’-ই মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি, ভাল-মন্দের জ্ঞান তৈরী করে। গেজের ক্ষেত্রে সেখানকার টিস্যু নষ্ট হওয়ার ফলেই তার মস্তিষ্কের সাধারণ ক্ষমতা লোপ পায়।
কিন্তু মনস্তত্ত্ববিদ ম্যালকম ম্যাকমিলান মনে করেন সময়ের সাথে সাথে ফিনিয়াস গেজের মস্তিষ্ক অনেকটাই সেরে ওঠে। তার সবথেকে বড় প্রমাণ, কোচোয়ানের কাজ পেয়ে সে চিলিতে যায়। একদিনে তেরো ঘন্টার সেই কাজে তাকে প্রায় একশ মাইল পথ অতিক্রম করতে হত। রাস্তা বহু জায়গাতেই এবড়ো-খেবড়ো। তাছাড়া, যাত্রী যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রা করতে পারে, সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হত। মোট কথা, এই কাজে যে পরিমাণ দায়িত্ত্ব প্রয়োজন, তা গেজ যথাযথ পালন করত। যে কারণে এটা বলাই যায়, দুর্ঘটনার পরে তার স্বাভাবিক দক্ষতা আস্তে আস্তে অনেকটাই ফিরে আসে।
অবশেষে ক্রমাগত ‘এপিলেপ্টিক সিজার’ হতে হতে ১৮৬০ সালে ফিনিয়াস গেজ মারা যায়। তার মাথার খুলি ও সেই ট্যাম্পিং রডটি হার্ভার্ড মেডিকাল স্কুলের ওয়ারেন অ্যানাটমিকাল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। গেজ চলে গিয়েও নিউরোসায়েন্স ও সাইকোলজিতে গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে রইল।

ছবি সৌজন্যঃ সেম্যান্টিক স্কলার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + 20 =