বর্ণ-পরিচয়

বর্ণ-পরিচয়

সুপ্রতীম চৌধুরী
Posted on ২৯ আগষ্ট, ২০২১

অঞ্জন দত্তের একটা গানের সুর খুব ভাল লাগত ছোটবেলায়। গানটায় একটা লাইন আছে, “বংশের ইজ্জত রাখতে হলে বৌ হতে হবে ফর্সা!”
গানটা যদি বছর পঁচিশেক আগে না লেখা হয়ে গত সপ্তাহেও লেখা হত, সে ক্ষেত্রেও লিরিক্সে কোন রদবদল না করেই দিব্যি চলত, তাই না?
অবশ্য রঙ নিয়ে এই রঙ্গ শুধু আমাদের দেশজ সমস্যা নয় – বর্ডার নির্বিশেষে বর্ণবৈষম্যের রোগটা আন্তর্জাতিক। গত বছরই জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুকে ঘিরে গোটা পৃথিবী চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাতে কীই বা পাল্টাল!
অথচ ঘরের মধ্যে এসি অথবা ফ্যান চালিয়ে, কিংবা মাথায় আইসব্যাগ চাপিয়ে যদি ভাবা যায়, তাহলে দেখা যাবে বর্ণবৈচিত্র‍্য আসলে প্রকৃতির উৎকৃষ্ট খামখেয়ালিপনাগুলোর একটি। কীভাবে হল? চলুন, দেখা যাক।
মোটামুটি ৯৯.৯৯% নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষের উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা মহাদেশ। শুরুতে মানুষের শরীরে লোমের আধিক্য ছিল। কিন্তু বিষুব অঞ্চলে (equatorial region) তাপমাত্রার আধিক্যের জন্য শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার তাগিদে মানবদেহে স্বেদগ্রন্থী (sweat glands) বৃদ্ধি পায়। লোমের ঘনত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে – যাতে অল্প সময়ে ঘাম উবে গিয়ে (evaporation) দেহ ঠাণ্ডা হতে পারে। এদিকে লোম কমে যেতেই নীচের ত্বক প্রকাশ্যে আসে। তার ফলে সূর্যের থেকে নির্গত অতিবেগুনী রশ্মি (ultraviolet rays) ত্বকের সংস্পর্শে আসে।
এই UV রশ্মি প্রকৃতির কাছে উভয় সংকট সৃষ্টি করল। এই রশ্মি একাধারে ‘শাপে বর’ এবং ‘বরে শাপ’। UV মানবদেহে ভিটামিন-ডি (ক্যালসিফেরল) তৈরি করতে সাহায্য করে,যা ছাড়া আবার শরীরে ক্যালশিয়াম শোষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালশিয়ামের অন্যতম অবদান হাড় ও দাঁতের গঠন ও সুরক্ষা। অন্যদিকে এই UV-ই দেহস্থিত ভিটামিন-বি৯ (ফোলেট)-কে ধ্বংস করে ভ্রুণের বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত মাত্রার UV-সংস্পর্শে ত্বকের ক্যানসারও হয়।
এমতাবস্থায় কি করা যায়? প্রকৃতি তো তার এত কোটি বছরের সৃষ্টিকে বিনষ্ট হতে দিতে পারে না। ডাকা হল মেলানোসাইটকে (melanocyte)। ত্বকের ঠিক নিচেই থাকে এই কোষ। এর থেকেই তৈরি হয় মেলানিন। কালো/বাদামী রঙের এই রঞ্জক পদার্থ বা পিগমেন্ট ঠিক করে মানুষের চুল, চামড়া এবং চোখের রঙ কী হবে।
বিষুব অঞ্চলের মানুষের দেহে এই পিগমেন্ট বাড়িয়ে দিল প্রকৃতি। ফলে UV রশ্মির ফোলেট-ধ্বংসকারী, অপকারী দিকটা নিয়ন্ত্রণ করা গেল। মেলানিনের আধিক্যে মানুষ শ্যামবর্ণ হল।
এবার, সময়ের সাথে সাথে মানুষ ছড়িয়ে পড়তে লাগল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। কিছু মানুষ মেরুপ্রদেশের (polar region) কাছাকাছি বসবাস শুরু করল। কিন্তু সেখানে সূর্যের তেজের প্রবলতা কম হওয়ার দরুণ UV-এর প্রভাবও কম। এদিকে বাদামী চামড়ায় UV এমনিতেই কম ঢুকবে। শরীরে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ কম হয়ে যাবে তো! এবার অভিযোজন (adaptation) ভার্শান ২.০ শুরু হল মানুষের দেহে। আগের সেই মেলানিন হ্রাস পেল। ফলে, দেহের পক্ষে অনুকূল পরিমাণ UV আসতে কোনো বাধা রইল না। এবং এরই ফলে, গায়ের রঙ গৌরবর্ণ হল।
এভাবেই বিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে ভিন্নবর্ণের মানবপ্রজাতি আজকের দিনে পৌঁছেছে।
রাস্তার ধারে ফেস-ক্রিমের বিজ্ঞাপনে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবিগুলোকে, ফটোশপের স্লাইডার ঠেলে ঠেলে যেভাবে একজন শিল্পী ঝাঁ-চকচকে করে তোলে, কোনো এক বিস্মৃত, আদিম কালে প্রকৃতিও মাথা খাটিয়ে, মেলানিনের স্লাইডার বাড়িয়ে কমিয়ে ভিন্ন জায়গার মানুষকে ভিন্ন বর্ণের করেছিল।
বিজ্ঞানের কাজই তো নতুন ভাবে ভাবতে শেখানো। আসুন না, মেরি অ্যানের বিয়েও হোক কোন এক ফর্সা ছেলের সাথে। রঙের তারতম্যটা নাহয় থেকে যাক ভ্যান গগের মাস্টারপিসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − eight =