বহুর অধ্যাবসায়ে নোবেল

বহুর অধ্যাবসায়ে নোবেল

অর্পন নস্কর
Posted on ১০ অক্টোবর, ২০২১

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ও দর্শনঋদ্ধ ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে নায়ক শশী বলেছিলো, “কারও একার খেয়ালে তো ডাক্তারি শাস্ত্র হয়নি।হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক সারাজীবন ধরে পরীক্ষা করে সব আবিষ্কার করেছেন।” ‘আমি’ নয়, বহুর শ্রমেই বিজ্ঞান এবং জগতের গতি- এই সার কথা যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের তথা বিজ্ঞানের এবং জগতেরও।
১৯৯০ এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক ডেভিড জুলিয়াসের মাথায় আসে একটি প্রশ্ন- লঙ্কায় যে ক্যাপসাইসিন নামের রাসায়নিক যৌগটি ত্বকের সংস্পর্শে এলেই জ্বালা অনুভব করায় তার মূল বিজ্ঞানটা কী? নেহাত আলটপকা নয়। স্নায়ুকোষের জন্যই যে মস্তিস্কে জ্বালার অনুভুতির বার্তা আসছে এবং তার ফলেই আমরা জ্বালা অনুভব করছি একথা আগেই আবিষ্কৃত। মস্তিষ্কের পৃথক পৃথক স্নায়ুকোষের জন্যেই যে আলাদা আলাদা অনুভূতি পাই আমরা – এ আবিষ্কারের জন্যেই ১৯৪৪ সালে জোশেফ এলেনগার এবং হার্বার্ট গ্যাসার চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পান। তারও আগে সপ্তদশ শতকে ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) ত্বকের সাথে মস্তিস্কের একধরনের সংযোগ রয়েছে। সেই সংযোগের জন্যেই আগুনে হাত দিলে জ্বালার অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌঁছায়। ১৯৪৪ এ জানা গেল দেকার্ত অনুমিত সংযোগকারী আসলে স্নায়ু তন্তু যা, স্নায়ুকোষে ব্যাথার জ্বালার বার্তা পাঠায় বলেই আগুনে হাত দিলে গরম লাগে, রফলে হাত দিলে শিহরণ। অতএব ৯০ এর দশকে জুলিয়াসের মাথায় আসা প্রশ্নটি আর একটু সূক্ষ্ম করে বলা যায়- কেমন করে তাপ ত্বকের সংস্পর্শে আসা মাত্রই বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো বার্তা যাচ্ছে মস্তিষ্কে এবং জ্বালা অনুভূত হচ্ছে ? তাপ ও স্নায়ুর মধ্যিখানের উপাদানটা কী? এই উপাদানটি আসলে একধরণের সেন্সর বা রিসেপ্টর।
একুশ শতকের দুই দশক পার করে অর্থাৎ প্রায় তিন দশকের পরিশ্রমে জুলিয়াস আবিষ্কার করলেন ঐ মাঝের উপাদান বা রিসেপ্টরটি হলো -TRPV1। রিসেপ্টর বা সেন্সরটি খুঁজে পাওয়াও দীর্ঘ শ্রমের ফসল। জুলিয়াস ও তাঁর সহকর্মীরা লক্ষাধিক ডিএনএ অংশের একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন।
এইসব ডিএনএ আমাদের শরীরের এমনসব জিনে রয়েছে, যেগুলো তাপ, ব্যাথা বা নানারকমের স্পর্শে জেগে ওঠে। জুলিয়াস ও তাঁর সহকর্মীরা ধরে নেন এই সংগ্রহশালাতেই একটি ডিএনএ অংশ আছে যে ডিএনএ-র মধ্যেকার সংকেতবদ্ধ প্রোটিন ক্যাপসাইসিন নামের রাসায়নিক যৌগটির সংস্পর্শ পেলেই উদ্দীপনা জাগাবে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে জুলিয়াস ও তাঁর সহকর্মীরা দেখেন একটি নির্দিষ্ট জিন ক্যাপসাইসিনের সংস্পর্শে আসা মাত্রই মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষকে উদ্দীপ্ত করছে। পরবর্তী অনুসন্ধানে জুলিয়াসরা দেখেন বিশেষ একধরনের প্রোটিন তৈরিতে ভূমিকা নিচ্ছে জিনটি এবং ঐ প্রোটিন আমাদের স্নায়ুকে তাপমাত্রা, নানা রকমের স্পর্শের তারতম্য বুঝিয়ে দেওয়ার একমাত্র গাইড। ঐ প্রোটিনটি একটি আইওন চ্যানেল দ্বারা সংকেতবদ্ধ হয়ে আছে। ওই আইওন চ্যানেলটিই নতুন আবিষ্কৃত সেন্সর বা রিসেপ্টর। জুলিয়াসরা যার নাম দেন TRPV1।
আর কোন সেন্সারের জন্যে আমরা বুঝি স্পর্শের অনুভূতি বা চিনি গন্ধ – দেখালেন পাটাপুটিয়ান ও তার সহকর্মীরা। দেখালেন কীভাবে আমাদের ত্বক ও স্নায়ুগুলি বাইরের চাপের তারতম্য বুঝতে পারে। তাঁরা মানবদেহের এমন ৭২টি জিনকে নির্দিষ্ট করেন। পরের অনুসন্ধানে দেখেন এদের মধ্যে দুটি জিন বাইরের চাপে জেগে ওঠে। পিয়াজো-১(piezo1), পিয়াজো -২(piezo2)। পিয়াজো১ ও পিয়াজো ২ এর আইওন চ্যানেল বাইরের চাপে জেগে ওঠে। পিয়াজো ২ আইওন চ্যানেল স্পর্শের অনুভূতির দেয় আমাদের।
মহামারীকালে দেখেছি ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পরে স্বাদের অনুভূতি গন্ধের অনুভূতি পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সেন্সর গুলি অকেজো করে দেয় ভাইরাস। ফলে সেন্সরের আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন গবেষণার দিগন্ত খুলে দিল।
এই আবিষ্কারই জুলিয়াস ও পাটাপুটিয়ানকে নোবেল এনে দিল ২০২১ সালের শারীরবৃত্ত এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে। একটি আবিষ্কারের আড়ালে রয়ে যায় এমন বহু মানুষের দীর্ঘ অধ্যাবসায়। একজন ডেভিড জুলিয়াসের বা একজন আর্ডেম পাটাপুটিয়ানের স্বীকৃতির আড়ালে রয়ে যান অনেক নোবেল না পাওয়া নোবেলিয়েট।