বার্ধক্য কমানোর প্রয়াসে এযুগের প্রফেসর শঙ্কু!

বার্ধক্য কমানোর প্রয়াসে এযুগের প্রফেসর শঙ্কু!

সুদীপ পাকড়াশি
Posted on ১৭ অক্টোবর, ২০২১

ডেভিড সিনক্লেয়ার। জেনেটিক বিজ্ঞানী। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন। তারপর গবেষণা করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টটিউট অফ টেকনোলজি থেকে। বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাগারের প্রধান। সেখানে গত দু’দশক ধরে চলছে সিনক্লেয়ারের নিরলস গবেষণা। বিষয়বস্তু শুনে অনায়াসে তাকে ডাকা যেতে পারে আধুনিক যুগের প্রফেসর শঙ্কু! অ্যানিহিলিন পিস্তল বা মিরাকিউরাল মলম বা সেলিব্রান্ট ট্যাবলেট আবিষ্কারের মতই সিনক্লেয়ারেরও চেষ্টা এমন ওষুধ আবিষ্কার করা যা খেলে মানুষের বার্ধক্য পিছিয়ে যাবে! পিছিয়ে যাবে মানে ৮০ বা ৯০ বছর বয়সেও একজন বৃদ্ধ শারীরিকভাবে ৫০ বা ৬০ বছর বয়সী মানুষের মতই সক্ষম থাকবেন!
সিনক্লেয়ারের অনেক নাম, ডাক। হলিউড বা বলিউডের তারকারই মত। শুধু বিজ্ঞান জগতের বহু পুরষ্কারই তার ঝুলিতে রয়েছে তা নয়, টাইম ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০জন ব্যক্তির তালিকায় রেখেছে। টুইটার তার ভক্তের সংখ্যা দু’লক্ষেরও বেশি! সিনক্লেয়ারের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি কম নয়। একাধিক জৈব প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের সঙ্গে তিনি যুক্ত। এর মধ্যে অনেক জৈব প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি!
বিশ্বজুড়ে মানুষ, এমনকী অনেক বিজ্ঞানীরও ধারণা, বার্ধক্য মানুষের জীবনে অবশ্যম্ভাবী এক প্রক্রিয়া। ডেভিড সিনক্লেয়ার সেই প্রচলিত ধারণাটা ভাঙতে চাইছেন। তার লক্ষ্য মানুষের আয়ু বাড়ানো। অবশ্যই বৈপ্লবিক প্রয়াস। ব্রাজিলের বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সিনক্লেয়ারের জোরালো যুক্তি, “চাঁদে পা রাখা, অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার, কম্পিউটার আবিষ্কার যদি বৈপ্লবিক হয়ে থাকে তাহলে আমার গবেষণাকেও বৈপ্লবিক বলা অনুচিত হবে না। তাছাড়া বার্ধক্যকে আমি একদমই অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া বলতে চাই না। জীববিজ্ঞানের কোথাও লেখা নেই আপনি এবার বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। এটা একটা পদ্ধতিগত বিষয়। গবেষাণাগারে আমরা অন্য প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করে দেখেছি, এই পদ্ধতিতে অনেক বেশি বয়সেও কম বয়সীদের মত সুস্থ থাকা যায়। প্রমাণ মানুষের মধ্যেও প্রচলিত এই ধারণা ভাঙতে হবে।” সিনক্লেয়ার তার লেখা যে বইতে তার ভাবনার কথা লিখেছেন সেই বই (কেন আমরা বৃদ্ধ হই, কেন বৃদ্ধ হব না) কিন্তু ইউরোপে হট-কেক হয়ে গিয়েছে।
বুড়ো হয় কেন মানুষ? গত ২৫ বছরের গবেষণার পর সিনক্লেয়ারের পর্যবেক্ষণ, মানুষের শরীরে দু’রকমের তথ্য থাকে। একরকমের তথ্য সে পায় বংশগতভাবে। অন্যটি সময়ের সাথে সাথে, পরিবেশের কাছ থেকে। বংশগতভাবে পাওয়া তথ্যকে ডিজিটাল তথ্য বলে আর অন্যটি হল অ্যানালগ তথ্য, যাকে বলা হয় এপিজিনোম। এটা কোষের ভেতরের একটা পদ্ধতি যা বলে দেয় কোন জিন সক্রিয় থাকবে আর কোন কোন জিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। সিনক্লেয়ার জানাচ্ছেন, একটা কোষের ভেতর ২০ হাজার জিনের অস্তিত্ব। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এপিজিনোম পদ্ধতি তথ্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। তখন মানুষের শরীরের কোষগুলো ঠিক সময়ে সঠিক জিনকে আর চালু রাখতে পারে না। তাতেই মানুষ বয়সকালে ক্রমশ তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। ইঁদুর, হাতি এমনকী তিমি মাছের ওপরও সিনক্লেয়ার তার বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখেছেন। বলেছেন, “এক একটি প্রাণীর জীবনযাত্রা এক একরকম। স্বাভাবিকভাবে তাদের বয়সের বৃদ্ধিও বিভিন্নরকমের। তাই এই পদ্ধতি প্রয়োগের আগে আরও একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তা হল এক একটা মানুষ তার জীবনযাত্রায় কীভাবে খাদ্যাভ্যাস তৈরি করেছে। তাই ভবিষ্যতে কোনও ব্যক্তির স্বাস্থ্য কীরকম থাকবে তার অনেকটাই নির্ভর করবে তার জীবনযাত্রার ওপর, ডিএনএ-র ওপর নয়। গুটিকয়েক জিন আছে যারা শরীরের ভেতর এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাটা গড়ে তোলে। আমরা সেগুলোকে নিয়েও পরীক্ষা করে দেখেছি। এই জিনগুলো এপিজিনোমকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই কোনও মানুষের খাদ্যাভ্যাস ঠিক থাকে আর তার সঙ্গে ব্যক্তিটি যদি ব্যায়াম করে, নিয়মিত হাঁটে তাহলে সেই মানুষের ওপর আমাদের পদ্ধতিতে সৃষ্টি করা ওষুধ নিখুঁতভাবে কাজ করবে।”
মেরিল লিঞ্চ ব্যাঙ্কের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী বার্ধক্য সংক্রান্ত কর্মযজ্ঞে এই মুর্হুতে খরচ হছে বিশ্বে ১১ হাজার কোটি ডলার! ২০২৫-এ যা গিয়ে দাঁড়াবে ৬০ হাজার কোটি টাকায়! সিনক্লেয়ার বলছেন, তাদের সৃষ্টি করা ওষুধে মানুষ শেষপর্যন্ত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে আর চিকিৎসার পেছনে যদি সরকারের খরচই কমে যায় তাহলে সেই টাকা তারা উষ্ণায়ন প্রতিরোধে খরচ করতে পারে!
এগিয়ে চলুক সিনক্লেয়ারের গবেষণা। মানুষের বার্ধক্যজনিত সমস্ত অসুখ মুছে যাক সিনক্লেয়ারের সৃষ্টি করা ওষুধে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × one =