বাস্তুতন্ত্রের ধারক ‘কীস্টোন’ প্রজাতি

বাস্তুতন্ত্রের ধারক ‘কীস্টোন’ প্রজাতি

সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
সদস্য, সম্পাদকীয় বিভাগ, বিজ্ঞানভাষ
Posted on ১৮ মে, ২০২৫

প্রকৃতি এক ভারসাম্যের খেলা। বাস্তুতন্ত্রের জটিল প্রতিচ্ছবিতে এমন কিছু প্রজাতি আছে যাদের অনুপস্থিতি সমগ্র ব্যবস্থাটাকেই টলিয়ে দিতে পারে। এদের বলা হয় ‘কীস্টোন প্রজাতি’। এরাই বাস্তুতন্ত্রের মূল ভিত্তিপ্রস্তর। এরা হয়তো সেভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না বা এদের সংখ্যাও নেহাত কম, কিন্তু তাদের ভূমিকা একেবারে অনন্য, অপরিহার্য।

স্থাপত্যবিদ্যার ভাষায় একটি খিলানের কেন্দ্রীয় প্রস্তরটিকে বলে কীস্টোন, যা সমগ্র কাঠামোর ভার বহন করে। বাস্তুতন্ত্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিকারী না হয়েও, কিছু প্রাণী তাদের জীবনচক্র বা আচরণের মাধ্যমে কেবল নিজেরই নয়, অন্যান্য অনেক প্রাণীর জীবনকে প্রভাবিত করে চলে। এরাই হল বাস্তুতন্ত্রের মূল ভিত্তিপ্রস্তর। কীস্টোন নানা প্রজাতি এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত। জীববৈচিত্রে ভরপুর এই প্রজাতির মধ্যে মিষ্টি জলের সাঁতারু অমেরুদন্ডী প্রাণী থেকে শুরু করে আছে উভচর প্রাণী, মাংসাশী এমনকি তৃণভোজী প্রাণী। অনেক সময় এরা শীর্ষ শিকারী গল্পের নায়ক, আবার কখনো পরিবেশের স্থপতি- বিশেষ পার্শ্বচরিত্র। সুতরাং কোনো একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা নয় বরং এদের ছায়া সারা বাস্তুতন্ত্রে বিস্তৃত।

যেমন বীবর। উত্তর গোলার্ধের আধা-জলচর এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি যেন এক প্রকৌশলী। যে নদীকে বাঁধে, ভূমিকে রূপ দেয়। কাঠ, কাদা আর পাথর দিয়ে তারা বাঁধ বাঁধে। শুধুমাত্র নিজেদের জন্য নয়, এই বাঁধ ছোট মাছ, পাখি, উভচরের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। একটি বীবরের সামান্য পরিবর্তন জলব্যাবস্থায় একপ্রকার বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে, ধ্বংসও করতে পারে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এদের মলদ্বারের গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত একরকমের সুগন্ধি, ব্যবহৃত হত ঔষধি, খাদ্য এবং বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে। ফলত প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চলে যায় এরা। পরবর্তীতে সংরক্ষণ প্রচেষ্টা তাদের ফিরিয়ে আনে এবং একপ্রকার ‘প্রাণ-প্রযুক্তি’ হিসেবে আবার জলা এবং ভূমি পুনরুদ্ধার ঘটায় তারা।

আর একটা উদাহরণ হল ধূসর নেকড়ে। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরেশিয়ার এই শিকারী প্রাণী যুগ যুগ ধরে মানব সমাজকে মুগ্ধ এবং তাড়িত করেছে। এরা শীর্ষস্থানীয় শিকারি হলেও বাস্তুতন্ত্রর ভারসাম্য-রক্ষক হিসেবেও অনন্য। ইয়েলোস্টোনে নেকড়ের অনুপস্থিতি প্রমাণ করে তাদের অন্তর্লীন গুরুত্ব। মেনি টু বা ইউনিটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা অনুসারে ১৯২০ দশকের মানব সৃষ্ট বিলুপ্তির কারণে, ইয়েলো স্টোনে এই ধূসর নেকড়েদের অনুপস্থিতিই বাইসন ও এল্‌কের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়। সেইসঙ্গে উদ্ভিদ বৈচিত্র্য হ্রাস পায়, এমনকি নদী পথের পরিবর্তনও ঘটে। ১৯৯৫ সালে নেকড়েদের ফিরিয়ে আনার পর প্রকৃতি আবার স্বভঙ্গিমায় ফিরে আসে। পারস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রক্রিয়া-পরম্পরা (‘ট্রফিক ক্যাসকেড’) ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত স্তরে। যা নীরব সুরে জানিয়ে দেয়, কে এই এলাকার আসল নায়ক!

তবে সকল রক্ষকই বিশালকায় বা সম্মোহক নয়। যেমন, বিশাল তৃণভূমির প্রেইরি কুকুর। ছোট, হাস্যকর বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া গেলেও এরা সেখানকার প্রকৃতির এক অদৃশ্য কাণ্ডারী। ১৬০টিরও বেশি অন্য জীবপ্রজাতি তাদের খোঁড়া গর্ত ও ঘাসভূমির উপরই নির্ভরশীল। এদের বসতি যেন ঘাসের সমুদ্রে গড়া প্রবাল প্রাচীর। এটি একটি ছোট প্রজাতি, কিন্তু গ্রেট প্লেইন রেস্টোরেশন কাউন্সিলের মতে, এক মহাব্যবস্থার রূপরেখা বদলানোর জন্য এরা ‘কাফি’।

বাস্তুতন্ত্র হল অধ্যয়নের একটি বিশাল ক্ষেত্র – যত গভীরে খনন করা হবে, ততই তা আরও আকর্ষণীয় হবে। প্রতিটি বাস্তুতন্ত্র নির্দিষ্ট এব এই গ্রহের সমগ্র কার্যকারিতার সাথে সংযুক্ত। সুতরাং অনেক জটিল খাদ্যশৃংখল এবং একটি বাস্তুতন্ত্রের সূক্ষ্ম ভারসাম্য একক প্রজাতির ভারসাম্যের সঙ্গে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে। এক্ষেত্রে আরো একটি শব্দ সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত তা হল কীস্টোন মিউচুয়ালিস্ট – পারস্পরিক ভিত্তিস্থাপক। প্রকৃতিতে এমন উদাহরণ আছে যেখানে দুই বা ততোধিক প্রজাতি পারস্পরিক ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় যা, একটি বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একসাথেই এই প্রজাতিগুলি বৃহত্তর ব্যবস্থার মূল কান্ডারী হয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির মৌমাছি এবং পরাগায়নে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাই ধরা যাক। এক্ষেত্রে মৌমাছি এবং সেই নির্দিষ্ট উদ্ভিদ উভয়েরই প্রয়োজন আছে। অন্যান্য প্রজাতির সংখ্যাবৃদ্ধি এবং বৃহত্তর আবাসস্থলকে সাহায্য করার জন্য এরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল।

এখানেই শেষ নয়। প্রকৃতির এই সিম্ফনিতে উদ্ভিদের ভূমিকাও অনন্য। এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখ্য সামুদ্রিক কেল্প গুল্মের বন। সমুদ্রতলের এই ‘সবুজ অরণ্য’, কেবল এক নির্জন শৈবাল নয়, এখানে অসংখ্য সামুদ্রিক জীবের বাস। অক্টোপাস থেকে এঁটুলি, ঝিনুক থেকে সামুদ্রিক আর্চিন-সবাই এ বনের বাসিন্দা। কিন্তু এল-নিনো, দূষণ, আর বাণিজ্যিক শৈবাল আহরণের ফলে এই অরণ্য চুপসে যেতে বসেছে। কেল্প বন তাদের অসাধারণ দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পরিচিত। তাই ব্যাঘাত থেকে এগুলিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে, তারও নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। যখন স্তরে স্তরে একই সাথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তখন এগুলি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে । জাতীয় সামুদ্রিক অভয়ারণ্য, NOAA-এর সাথে অংশীদারিত্বে, বাণিজ্যিকভাবে কেল্প গুল্ম সংগ্রহকে এই বনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই বন যেন এক ক্রিয়-প্রতিক্রিয়া-নির্ভর হৃদস্পন্দন: যত বেশি আঘাত, তত কম পুনরুদ্ধার।সুতরাং প্রতিরক্ষামূলক আইন এক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয়।

অনাদিকাল থেকেই সাভানা মানবজাতিকে মুগ্ধ করে আসছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত এই ঘাসযুক্ত সমভূমিতে লম্বা ঘাসের মধ্যে জেব্রা আর হরিণ ঘুরে বেড়ায়। পূর্ব আফ্রিকার সাভানার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে এখানকার বিশাল প্রজাতি সাভানার হাতি কেবল দৃষ্টিনন্দন নয়, একপ্রকার বাস্তুসংস্থান নির্মাতা। উদ্ভিদ বৈচিত্র্য নির্ভর করে তাদের গতিবিধির উপর। অনেক এলাকায় বেশি হাতি থাকলে উদ্ভিদের রূপ পাল্টে যায়। আবার যেসব এলাকায় চোরাশিকারের কারণে তারা নেই, সেখানে একেবারে অন্যরকম দৃশ্যপট গড়ে ওঠে। ডেভিড ওয়েস্টার্ন-এর কাজ থেকে জানা যায়, একটি কীস্টোন প্রজাতির ঘনত্বই নির্ধারণ করে একটি ল্যান্ডস্কেপের গঠন ও সংরক্ষণ সম্ভাবনা। কিন্তু হাতির দাঁতের জন্য শিকার, পর্যটকদের নির্বিকার আচরণ এবং আদিবাসী, যাযাবর জীবনযাত্রার উপর নিপীড়ন একটি ভয়াবহ আখ্যানে পরিণত হয়েছে। হাতিদের রক্ষা করা, একটি কীস্টোন প্রজাতি আন্তঃসম্পর্কের ঘন নকশার বুনোটের একটি ছোট সুতো।

সবশেষে, প্রবাল প্রাচীরের দিকে চোখ ফেরানো যাক। রঙিন, প্রাণবন্ত অথচ অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ এই প্রবাল কেবল রঙিন পলি নয়, এরা একটি জীবন্ত জীব। প্রবাল নিজেই একটি কীস্টোন প্রজাতি। সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণী একই আচরণ প্রদর্শন করে না। কিছু প্রজাতির প্রবাল পরিবেশের উপর অন্যদের তুলনায় বেশি প্রভাব ফেলে। যেমন, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের প্যারট ফিশ বা টিয়া মাছ প্রকৃতপক্ষে প্রবাল ঘষে প্রবাল প্রাচীরকে আবর্জনামুক্ত রাখে পরিষ্কার করে। কিন্তু অতিরিক্ত মাছ ধরা, উষ্ণতা বৃদ্ধি, ‘ব্লিচিং ইভেন্ট’, সব মিলিয়ে এই ‘সাগর-নগরী’ অস্থির হয়ে উঠেছে। শুধু বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ নয়, দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং গণ-দায়বদ্ধতা।

শত শত বছর ধরে আদিবাসী কর্মীরা, পরিবেশবিদরা চিৎকার করে চলেছেন, “তৈরি হও, বিপদ আসছে!” কিন্তু আমরা ‘টেকসই’ (‘Sustainable’) শব্দটাকে ফাঁকা ফ্যাশনে পরিণত করেছি। আমরা ব্যস্ত ট্রেন্ডিং, হ্যাশট্যাগিং, মেটাভার্স-এ। আর প্রকৃতি? সে নিঃশব্দে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ম্যাকলুনাহান, পোলুনিন আর ডোন তাঁদের গবেষণায় আর্তনাদ করে বলছেন, “বাস্তুতন্ত্রকে সত্যি সত্যি বাঁচাতে চাইলে, প্রজাতির বৈচিত্র্যকে আঁকড়ে ধরো, কীস্টোন প্রজাতিকে রক্ষা করো, আর সেই অদৃশ্য সুতোটিকে বোঝো যার নাম প্রজাতিতে প্রজাতিতে সংযোগ”।
এখন প্রশ্ন, মানুষ কি নিজেই কীস্টোন প্রজাতি? কিছু বিজ্ঞানী বলেন, আমরাই ‘হাইপার-কীস্টোন’। তাই এই লড়াইয়ে শুধু বিজ্ঞান নয়, চাই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সমন্বয়, স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক সর্বস্তরে। তা হলে উত্তর কোথায়? আদিবাসী নেতৃত্বে। হ্যাঁ, যারা বন-পাহাড়-নদীকে পিতা-মাতার সমান দেখে, যাদের হৃৎপিণ্ড প্রকৃতির তালে নেচে ওঠে। বিশ্ব জনসংখ্যার ১০%-এরও কম আদিবাসী, তবুও তাঁদেরই হাতে ৮০% জীববৈচিত্র্যের ভার। আমরা যারা ‘সভ্য’ দাবিদার, আমরা প্রকৃতি নিয়ে কী করছি? তাই দায়িত্ব তুলে দিতে হবে তাঁদের হাতে, দায়িত্ব নিতে হবে আপনাদের আমাদের সকলকে।

আলোকচিত্র কৃতজ্ঞতা : ধৃতিমান মুখোপাধ্যায় (Brand Ambassador of roundglass)

One thought on “বাস্তুতন্ত্রের ধারক ‘কীস্টোন’ প্রজাতি

  1. Kankana

    Bortomane manob sobhyotar unnotir sathe jebhabe prithibir bharsamyo bighnito hochhe , lekhati khube gurutto purno tothyo uposthapon korechhe. Ei dhoroner bhabna r tar poriprekhhite sothik podokhhep khube joruri hoye uthechhe..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =