‘আজকে যে বেপরোয়া বিচ্ছু, শান্ত সুবোধ হবে কাল সে…’ কবীর সুমনের চালশের গানের একটা লাইনের উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, জার্নাল সায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণা জানিয়ে দিচ্ছে আজকে যে শিশু জন্মাচ্ছে, কাল তাকে বইতে হবে আবহাওয়া পরিবর্তনের বোঝা, যন্ত্রণা। কাল মানে ভবিষ্যৎ। বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদদের কাছে আবহাওয়ার পরিবর্তন এই মুহুর্তে মানুষের জীবনে গভীরতম এক সমস্যা। আবহাওয়ার পরিবর্তন মানে, এককথায় বিশ্ব উষ্ণায়ন। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রায় ক্রমশ গভীর সংকটে মানুষের জীবন, উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীরও জীবন।
২০২১-এ যে শিশু জন্মগ্রহণ করল, বিজ্ঞানীরা বলছেন তাকে ভবিষ্যতে অধিকাংশ বিপর্যয় গড়ে দু’বার দেখতে হবে। বিপর্যয় মানে, দাবানল, খরা, বন্যা, উষ্ণ তাপপ্রবাহ। গবেষণা জানাচ্ছে, বিপর্যয়গুলোর মধ্যে খরা, বন্যার কবলে সেই বড় হওয়া শিশুকে তিনবার পড়তে হতে পারে। আর তাপ প্রবাহ? আবহাওয়াবিদদের মতে তাপ প্রবাহের শিকার সে সাতবার হতে পারে! এটা আজকের শিশুর ভবিষ্যতের পরিসংখ্যান, যখন তার বয়স হবে ৬০-এর কাছাকাছি।
যে প্রোজেক্ট থেকে ওপরের পরিসংখ্যান জোগাড় করেছেন বিজ্ঞানীরা, তার নাম ইমপ্যাক্ট মডেল ইন্টারকমপ্যারিজন প্রোজেক্ট (আইএসআইএমআইপি)। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্নরকমের প্রভাব নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছিল। তথ্য ব্যবহ্রত হয়েছিল বিভিন্ন দেশের মানুষের ওপর। এর সঙ্গে বিজ্ঞানীরা যোগ করেছিলেন মানুষের আয়ু সংক্রান্ত তথ্য, আবহাওয়া পরিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য।
পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ থেকে শেষপর্যন্ত বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, এই মুহুর্তে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ‘অপর্যাপ্ত জলবায়ু নীতির’ জন্য সৃষ্ট বিপজ্জনক ও চরম ঘটনাগুলো পৃথিবী জুড়ে ঘটে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের দেওয়া হিসেব জানাচ্ছে বিশ্বের ১৫ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে চরম ঘটনা ঘটছে। বিজ্ঞানীরাই জানাচ্ছেন, প্যারিস ক্লাইমেট চুক্তি মেনে দেশগুলো যদি আবহাওয়া ও জলবায়ু নীতি তৈরি করতে না পারে তাহলে এই শতকের শেষে সমস্তরকমের চরম ঘটনা বেড়ে ৪৬ শতাংশ হয়ে যাবে!
গবেষণা থেকে আরও জানা গিয়েছে, আজ জন্মানো শিশুর যখন ৪০ বছর বয়স হবে, তার জীবন হবে এক যন্ত্রণাময় জীবন! খরা, তাপ প্রবাহ, বন্যা, শষ্যের ক্ষতি হয়ে মানুষের খাবারের অভাব-এত রকমের দুর্যোগের সামনে আজ জন্মানো শিশুকে ৩০ বছর পর পড়তে হবে যে বিজ্ঞানীরা বলছেন ভবিষ্যতের মানুষের বেঁচে থাকা হবে ‘নজিরবিহীন’!
গবেষণা ভবিষ্যতের মানুষ যাতে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারে তারও উপায় বলে দিয়েছে। সেই উপায়ে কোনও ম্যাজিক নেই এবং সেটা সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীরা, আবহাওয়াবিদরা বিশ্ব জুড়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের কানে বার বার ঢোকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পৃথিবীর উষ্ণায়ন কমানো। উষ্ণায়নের মাত্রা এখনই ২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছে! আবহাওয়াবিদদের কাতর আবেদন, একে অন্তত ১.৫ ডিগ্রির নিচে আনতে হবে! বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন এত কমিয়ে ফেলতে হবে যাতে মনে হয় দূষণ বন্ধই হয়ে গিয়েছে! তাহলেই পৃথিবীতে সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যতের প্রজন্মের ওপর চরম ও বিপজ্জনক ঘটনার ঘনঘটা ২৪ শতাংশ কমিয়ে ফেলা যাবে!
কবীর সুমনেরই আরও আর একটি গানের লাইনে শেষ হতে পারে এই নিবন্ধ। ‘মানুষ জাগলে তবেই কাটবে অন্ধকারের ঘোর…’!