ভাষা বৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্যের সম্পর্কের পরম্পরা

ভাষা বৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্যের সম্পর্কের পরম্পরা

শিবাংশু মুখোপাধ্যায়
Posted on ৫ আগষ্ট, ২০২১
ভাষা বৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্যের সম্পর্কের পরম্পরা

[ভাষার বৈচিত্র্যের ও জীববৈচিত্র্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্দ। কোনো জনজাতি বিপন্ন বা অবলুপ্ত হয়ে গেলে যেমন জীববৈচিত্র্যের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে, তেমনই কোনো প্রজাতি বিপন্ন হলে মানুষের জীবনেও তার প্রভাব পড়ে। আজ প্রথম কিস্তি। ]

সেদিনই কয়েকজন তরতাজা পড়ুয়া যুবকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, বিজ্ঞানের আবিষ্কার নিয়ে। মানবসভ্যতায় কীভাবে এবং কবে কবে মানুষের প্রয়োজন, জিজ্ঞাসা, আর জিগীষা – জ্ঞানের চোখে চোখ রেখে, যুক্তির চালচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের পরম্পরা তৈরি হয়ে আসছিল – আলোচনার চাকা গড়াচ্ছিল সেইদিকেই। আমরাও আছিলায় সেই চাকা গড়াতে দিচ্ছিলাম। খানিকক্ষণ বাদে আমরা প্রায় সকলেই লক্ষ্য করলাম সেই চাকার এক অপারযোগ্য ব্যাভিচারী কূট কাদায় আটকে গেছে। সেখান থেকে বেরোবার পথ নেই। কিংবা থাকলেও জীবৎকালের সুনিশ্চিৎ মানচিত্র ছেড়ে বেরোনোর রিস্ক নিতে আমরা সকলেই নারাজ। অতঃপর, দায় ও দায়িত্বের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে আমাদের মন স্বান্তনা দিয়ে আলোচনান্তরে রওনা দেওয়া হল। সেই অপারযোগ্য ব্যাভিচারী কূট কাদা হল, গোলোকায়নের গোলোকধাঁধা ও তার মেরুকৃত আনন্দ, হয় বোঝো এবং প্রভুত রোজগার কর, না-হয় বুঝে লাভ নেই – সুবিধে হল কিনা, আনন্দ ও আরাম হল কিনা দেখ! ব্যস!

শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি করে ওই প্রয়োজন আর জ্ঞানের বন্ধুত্বকে সওদাগরদের কাছে বন্ধক রাখতে শুরু করল মানুষ। নানা কারণেই অবশ্য। এই রচনায় সেসব আলোচ্য নয় মোটেই। তবুও সিঁড়ি আমায় ভাঙতে পারে তাই আমি সিঁড়ি ভাঙি না বলে সোজা ছ-তলার ছাদ ছিঁড়ে লাফ দিয়ে পড়তে পারব না মাটিতে লুটিয়ে। আমরা সকলে ঠিক কোথায় লুটিয়ে পড়ছি – সেটা জানা দরকার বোধহয় সকলেরই, আর জানা দরকার প্রয়োজন আর জ্ঞানের বন্ধুত্বকে সওদাগরের হাত থেকে মুক্ত করে কীভাবে আজও মানুষের কোলের কাছে টেনে আনা যায়।

সটান দৃষ্টান্তে আসা যাক। গ্রামের পেঁকো রাস্তা। চটচটে। মনে পড়বে সকলেরই, সমাপ্তির নায়কের মেয়ে-দেখে ফিরে আসার দৃশ্য, সত্যজিতের ছবিতে। সরকার গ্রামে-গঞ্জে কতটা কাজ করছেন সেটা বিচার্য হয়, ওই চটচটে রাস্তা কতটা শুখা পিচের মোড়কে ঢাকা হল তার ওপর নির্ভর করে। এখন আপনি কোন মেজাজে অধ্যুষিত সেটা কী আপনি নিজেও জানেন? কারণ, এক ধরনের নিরুত্তর জিজ্ঞাসা আপনাকেও গ্রাস করেছে জানি, নিশ্চিৎ জানি। সেটা আসলে ওই প্রথম স্ববকে উল্লিখিত পাঁক।

এখন লক্ষ্য করুন। একটা ছ-ফুটের দাঁড়াশ। এঁকে বেঁকে অন্তঃসলিলা নদীর মতো ওই শুখা পিচ অতিক্রম করতে চাইছে। পারছে না। তার পেটে সারি দিয়ে রয়েছে যে পেশীমণ্ডলী, তারা ওই শুকনো চত্বরে কাজ কম করতে পারছে। পারাপারের কষ্ট পৌঁছে দিচ্ছে সাপের মস্তিষ্কে। কিন্তু মানুষ। মানুষ তো খুশি। বিচুলি-বোঝাই ট্রাক্টর যে দিব্বি চলে সেই পিচ-পিঠের ওপর দিয়ে। কাদার মধ্যে চাকার অসুবিধে, পিচের ওপর সাপের মস্তিষ্ক – কোনটা আপনি বেছে নিলেন? নিশ্চয়ই চাকার সুবিধে। স্বাভাবিক। আপনি জন্মাবধি জেনে এসেছেন, সবার ওপরে মানুষ সত্য। অন্য কেউ নয়। আমার এবারের নিবেদন আপনার ওই বেছে নেওয়ার লীলাখেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে। বিষয়টা আপতদৃষ্টিতে খুবই রসহীন, তবু জীবে প্রেম আছে সেইখানেতে। এবার সেই জীবের জগৎ যা একান্তই প্রকৃতির সৃষ্টি – সেটাকে মানুষ যতই প্রযুক্তি ও উন্নয়ন দিয়ে পালটে ফেলুক না কেন – সেই জীবজগতের সঙ্গে মানুষের যোগ অবিচ্ছিন্ন। সেই নিবীড় যোগ কেমন এখন সেই কথা বলব।

ভাষার বৈচিত্র্যের ও জীববৈচিত্র্যের মধ্যে এক গভীর সুনিবীড় সম্পর্ক আছে – এই কথা এখন ভাষাতাত্ত্বিক তো বটেই, বিজ্ঞানচর্চার নানান শাখার কর্মীরাও জানেন এবং স্বীকার করেন। একটা ভাষার শব্দভান্ডার ওই ভাষা-ব্যবহারকারী কৌমের আদি জ্ঞানেরও ভান্ডার হিসেবে কাজ করে। একটা কৌমের পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে যে বিশেষ জ্ঞান, নিজস্ব জীবন ও জীবিকা সম্বন্ধে যে ভাষার প্রয়োগ সেইসবই তার আদি জ্ঞানের আধার। ইদানিং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে ভাষা-বৈচিত্র্য ও জীববৈচিত্র্যের সম্পর্কের গাণিতিক হিসেব কষে দেখানো হয়েছে। সেইসব প্রবন্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূলত প্রজাতির এমনকি স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিভিন্নতার উচ্চহারের (স্পিসিস রিচনেস) ভিত্তিতে ভাষা ও জীববৈচিত্র্যের মধ্যেকার গাণিতিক সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যাইহোক, ওই সম্পর্কের হিসেব নিকেশ বেশ জটিল। বরং, আমি ওই একই সম্পর্ককে ভারতের পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী কীভাবে সহজ করে বোঝাতে পারি সেই চেষ্টা করেছিলাম। সেখানে আমি দুটো চলরাশি (ভ্যারিয়েবল) হিসেবে দুটো সহজ জিনিসকে পাশাপাশি রেখেছিলাম। এক হচ্ছে, একটা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার নিরিখে সেই রাজ্যের প্রধান ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা আর দুই হচ্ছে সেই রাজ্যের আয়তনের তুলনায় মোট অরণ্যময় এলাকা অর্থাৎ রাজ্যের যতখানি অঞ্চল অরণ্য বা বনানী দিয়ে ঢাকা। এবং পিয়ার্সনের “r” ব্যবহার করে আমি দেখেছিলাম, ওই দুই চলরাশির মধ্যে পারম্পর্য (কোরিলেশন) খুবই উল্লেখযোগ্য। যেহেতু, অন্যান্য গবেষণার মতো, প্রজাতির বৈচিত্র্যের ঘনত্ব ইত্যাদির রাজ্যভিত্তিক তথ্য আমি পাই নি, সেহেতু ফন্দি এঁটেছিলাম অরণ্যের আয়তনের নিরিখেই আমি ওই কাজ সামলাব, কারণ অরণ্য বনানীর মধ্যেই যে প্রাণের বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি, এই কথা সবাই একবাক্যে মেনে নেবেন। এবং হিসেব কষার পর দেখলাম, আমার এই কৌশলটা বেশ খেটে গেল।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − 4 =