
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একটি সন্তানের ভূমিষ্ঠ হতে সময় লাগে ৯ মাস ৯ দিন। প্রথম কয়েকমাস তাকে বড় যত্নে ও চোখে চোখে রাখতে হয়। তার শরীর পৃথিবীর পরিবেশের জন্য অপরিপক্ব, ধীরে ধীরে সে খাপ খেতে শেখে। এ যেন কিছুটা তেমনই। আট দিনের মহাকাশ যাত্রা ধৈর্যর পরীক্ষা নিতে নিতে ৯ মাসে গিয়ে ঠেকলো। ৫৯ বছর বয়সী সুনিতা এবং ৬২ বছর বয়সী উইলমোর মহাকাশযান থেকে ভূমিষ্ঠ হলেন ১৯ মার্চ, ২০২৫। জুটির নিরাপদ প্রত্যাবর্তন উদযাপন করতে গোটা বিশ্ব উন্মুখ। তবে মহাকাশে একজন মহাকাশচারী যতটা সময় কাটিয়েছে, এটি তার মধ্যে দীর্ঘতম নয়। সেই রেকর্ড, রাশিয়ার মহাকাশচারী ভ্যালেরি পলিয়াকভের দখলে রয়েছে। ১৯৯৪ সালে মির মহাকাশ স্টেশনে, ভ্যালেরি এক বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি একটি পরিকল্পিত মিশন ছিল। বেশিরভাগ পরিকল্পিত মহাকাশ মিশন এত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সুনিতা উইলিয়ামস ও ব্যারি উইলমোরের ফিরে আসার বিষয়টি বার বার আশা-হতাশার মধ্য দিয়ে গেছে। এরই মাঝে তাদের কষ্টকর দিনাতিপাতের ছবি এবং ভিডিও ক্লিপ পৃথিবীর মানুষদের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠেছে বারংবার। কল্পনাতেও বেগ পেতে হয়েছে একটি ঘর যা কখনো খোলা হয়নি, তার মধ্যে দিনযাপনের ব্যাথা ! বাকিটা ইতিহাস।
মহাকাশচারীদের শূন্যের মহাকর্ষহীন পরিস্থিতিতে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষিত করা হয়। কিন্তু মানুষের শরীর দীর্ঘ সময় ধরে এর জন্য উপযুক্ত নয়। মহাকর্ষীয় শক্তি আমাদের হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিপরীতে, মহাকাশে নতুন হাড়ের কোষ সাধারণ গতিতে তৈরি হয় না। ফলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। ফিরে আসার পর, এই ক্ষতি অপূরণীয়। হৃৎপিন্ডের পেশীগুলিও শিথিল হয়ে পরে। মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণের অভাব, রক্ত প্রবাহের পরিবর্তন ঘটায়, যার ফলে মাথায় রক্তের পরিমাণ বাড়ে, শরীরের অন্যত্র রক্তের পরিমাণ কমে যায় এবং রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি থাকে। রক্তের পাশাপাশি, অন্যান্য তরলও মাথায় জমা হয় — কিছুটা স্থায়ী সর্দির মতন। তরলের এই সঞ্চয়, মহাকাশচারীদের চোখের আকারকেও বিকৃত করে, দৃষ্টিশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। সুতরাং ফিরে আসার পর যে এঁদের হাঁটতে সমস্যা হবে, দেখতে সমস্যা হবে এবং প্রায়ই মাথা ঘোরা অনুভব হবে, তা বলা বাহুল্য। সুনিতা উইলিয়ামস ইতিহাসে অন্য যেকোনো মহিলার চেয়ে বেশি সময় মহাকাশে হেঁটেছেন। বিজ্ঞানীরা কিছু সময় ধরে মহাকাশে বিকিরণ এক্সপোজারের সমস্যার বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন। তবে এখনও কোনও এর ‘কেস স্টাডি’ নেই।
মহাকাশচারীদের পাশাপাশি উদ্ধার মিশনে জড়িত সকলে যে ধৈর্য এবং স্থিতিশীলতা তা তারিফের। তবে এই সুখময় সমাপ্তির আগে ছিল চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। স্পেসএক্সের একটি ড্রাগন মহাকাশযান ফ্লোরিডার উপকূলে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৫.৫৭ মিনিটে (৩.২৭ সকাল IST) সমুদ্রে পড়ে। সুনিতা উইলিয়ামসের ফিরে আসার উদযাপন শুরু হয় কেবল তখনই যখন মহাকাশযানটি একটি আগুনের বলের মতো বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং মহাসাগরে পড়ার পথে চলতে থাকে। তবে শেষের ধাপটি ছিল সবচেয়ে বিপদসংকুল, যখন মহাকাশযানটি বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছে। এ সময় ক্যাপসুলটির গতি ২৮,৮০০ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত পৌঁছায়। এর থেকে সৃষ্ট ঘর্ষণে যানটির বাহ্যিক আবরণের তাপমাত্রা প্রায় ১,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুলটি ফেনোলিক-ইম্প্রেগনেটেড কার্বন অ্যাব্লেটর (পিকা) এর একটি তাপ-প্রতিরোধী আবরণে ঢাকা। ক্যাপসুলটি যখন সমদ্রের জলে পড়ে, তখন এটি চকচকে সাদা থেকে বাদামী রঙ ধারণ করে। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় বাইরের খোলস পুড়লেও যাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। ‘স্প্ল্যাশডাউন’ বা মহাকাশযানের সমুদ্র-অবতরণের সময় লক্ষ ছিল ঘণ্টায় ২৫ কিমি গতি অর্জন। ড্রাগন মহাকাশযানে মোট ছয়টি প্যারাশুট ছিল। দুটি ড্রোগ প্যারাশুট যা এটিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশের পর স্থিতিশীল করতে সাহায্য করে। বাকি চারটি প্রধান প্যারাশুট অবতরণের আগে মহাকাশযানকে ধীর করতে ব্যবহৃত হয়। সমুদ্রের দিকে আসার কয়েক মিনিট আগে, সমুদ্রের কাছে দুটি প্রধান প্যারাশুট খোলা হয়, যা ক্যাপসুলকে স্থিতিশীল এবং ধীর করে। এক মিনিট পর, আরও চারটি প্যারাশুট খোলা হয়, যাতে এর গতি আরও ধীর হয়। যখন যানটি সমুদ্রে ভাসতে শুরু করে, তখন পরবর্তী পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। প্রথম দলটি যানের কাছে পৌঁছে, হ্যাচ খোলার আগে গ্যাস লিকেজ পরীক্ষা করে। পরে যাত্রীদের বের করে আনে। অবশেষে, উল্লাস।