মহাগুণময় নীলকান্তমণি

মহাগুণময় নীলকান্তমণি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৭ মার্চ, ২০২৫

কল্পনা করুন, এমন একটি ফোন স্ক্রিন যেটাতে আপনি শতবার মাটিতে ফেলা সত্ত্বেও আঁচড় লাগে না। কিংবা এমন একটি চশমা যা আলোর ঝলকানি প্রতিরোধ করে চোখকে আরাম দিতে পারে। অথবা গাড়ি-জানালার এমন একটি কাচ যাতে ধুলো ময়লা ধরে না। এগুলি সবই সম্ভব। ‘স্যাফায়ার’ বা নীলকান্তমণি তৈরির একটি নতুন পদ্ধতি দিশা দেখিয়েছে এমনই সব সম্ভাবনার। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্টিনের গবেষকরা স্যাফায়ারকে আরও দৃঢ় করার এক কৌশল আবিষ্কার করেছেন। সেখানে এমন একটি উপাদান রয়েছে, যা স্যাফায়ারকে ইলেকট্রনিক্স, পরবর্তী প্রজন্মের কাচ, এমনকি মহাকাশ অভিযান প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত করবে।
শুধু দেখনদারি চাকচিক্য নয়, স্যাফায়ার তার কঠোরতা এবং অন্যান্য কাম্য বৈশিষ্ট্যের কারণেই উচ্চমূল্যের এক রত্ন। ওয়াকার ডিপার্টমেন্ট অফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং নতুন গবেষণা প্রধান চিহ-হাও চ্যাং বলছেন, “কিন্তু যে বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য এটি এত আকর্ষক, সেগুলিই এটিকে ক্ষুদ্র-পরিসরে উৎপাদন করা কঠিন করে তোলে।” চ্যাং এবং তাঁর দল আশা করেন, ‘মেটিরিয়ালস হরাইজন্স’-এ প্রকাশিত নতুন স্যাফায়ার-ভিত্তিক ন্যানোস্ট্রাকচারের গবেষনাটি এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। ন্যানোস্ট্রাকচারগুলি এই উপাদানের শক্তি এবং কঠোরতাকে অক্ষুন্ন রাখতে পারে, যদিও এটি ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ স্যাফায়ারের মতো আচড় -প্রতিরোধী নয়। অপরদিকে, ন্যানোস্ট্রাকচারগুলিকে টাংস্টেন বা চিরাচরিত কাচের সাথে তুলনা করা চলে। এই নতুন স্যাফায়ার ন্যানোস্ট্রাকচারগুলি কুয়াশা, ধূলো এবং ঝলমলে আলো প্রতিরোধ করে। বলা যেতে পারে, এদের নিজেকে নিজে পরিষ্কার করে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। আরেক গবেষক কুন-চিয়েহ চিয়েন বলেন, ” আগে ন্যানোস্ট্রাকচারগুলিকে সাধারণত ভঙ্গুর হিসাবেই দেখা হত, কিন্তু এখন নতুন তৈরি স্যাফায়ার এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। ” মথের চোখ থেকে প্রেরণা নিয়ে, স্যাফায়ার ন্যানোস্ট্রাকচারের টেপার্ড প্রোফাইল, আলোকে সহজে প্রবাহিত করতে এবং তার উজ্জ্বলতা কমাতে সাহায্য করবে। এখনকার ন্যানোস্ট্রাকচারের উপরিপৃষ্ঠের শক্তি এবং অঙ্গ বিন্যাস, এক প্রবল জলাসক্ত ‘সুপারহাইড্রোফিলিক’ পৃষ্ঠ তৈরি করে, যা সহজেই জলকে আকর্ষণ করে। এই কাঠামোগুলোকেই যদি ‘সুপারহাইড্রোফোবিক’ পৃষ্ঠে রূপান্তরিত করা যায় তাহলে জলকণাগুলো পদ্মপাতার মতন পৃষ্ঠ থেকে গড়িয়ে পড়তে পারবে। “নতুন স্যাফায়ার ন্যানোস্ট্রাকচারগুলো কেবল বহুমুখীই নয়, যান্ত্রিকভাবেও শক্তিশালী। যা তাদের টেকসই করবে এবং কর্মক্ষমতার দিক থেকে ব্যবহারিক উপযোগিতায় এগিয়ে রাখবে,” বলেছেন গবেষণাপত্রের আরেক লেখক মুহাম্মদ কেপেনেকসি। এই প্রযুক্তির অনেক সুবিধা । গ্রাহকদের জন্য এটি এমন স্মার্টফোন স্ক্রিন তৈরি করবে যা কম বা তীক্ষ্ণ আলোতে পড়া সহজ । গাড়ি-জানালা, কুয়াশা এবং ধুলাবালি মুক্ত থাকবে। ক্যামেরায় লেন্স-এ দেখতে বা ছবি তুলতে উজ্জ্বলতার জন্য অসুবিধা তৈরি হবে না।
এর সম্ভাবনার চিত্রটিকে আরও একটু বড় পরিসরে দেখা যাক। পরবর্তী প্রজন্মের মহাকাশ ভ্রমণে, এর ধুলা নিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলির কল্যাণে মিশনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি অন্যান্য গ্রহে অবতরণকালে ধূলোর স্তূপে আবৃত হবে না। মহাকাশে ধোয়ামোছার জল সহজলভ্য নয়। সেক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি শক্তিশালী ইনফ্রারেড সেন্সর এবং মহাকাশযানগুলির সুরক্ষামূলক জানালার সৃষ্টি করতে সহায়ক হবে। “আমাদের স্বয়ং-পরিচ্ছন্নকারী প্রযুক্তির স্যাফায়ার পৃষ্ঠগুলি শুধু মাধ্যাকর্ষণ বল ব্যবহার করেই ৯৮.৭% ধূলিমুক্ত থাকতে সক্ষম,” বললেন ধুলোবিদ অ্যান্ড্রু টুনেল। তিনি আরও বলেন, “এটি বিদ্যমান ধূলা-নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির তুলনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি। বিশেষ করে মহাকাশে ব্যবহারের জন্য এগুলি অত্যন্ত উপযোগী”। গবেষকরা এই প্রযুক্তিকে বাস্তবায়িত করার জন্য কাজ করছেন। এটি আরও কি করে উন্নত করা যায় তার বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করছেন। তাঁরা বহু সংখ্যক নমুনার উপর এই ন্যানোস্ট্রাকচারগুলি প্রয়োগের জন্য উৎপাদন বাড়াচ্ছেন। পাশাপাশি এগুলির আরও বাস্তবসম্মত ব্যবহারের জন্য অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

8 − four =