রক্তচক্ষু

রক্তচক্ষু

 সুপ্রতিম চৌধুরী
Posted on ১০ অক্টোবর, ২০২১

কাঁকুড়ে জমির উপর দিয়ে খুব ধীরে সড়সড় করে এগিয়ে চলেছে বিষধর সাপটি। মাথার উপর গনগনে সূর্য। কিন্তু তার মাথা ঠাণ্ডা। লকলকে জিভ দিয়ে বাতাস থেকে তথ্য নিতে নিতে সে নিজের পরবর্তী ‘টার্গেট লক’ করেছে। আরেকটু গেলেই খাবার – একটা সাড়ে সাত ইঞ্চির টিকটিকি। সাপটা পৌঁছে গিয়ে সবে হাঁ করেছে। কিন্তু সব কেমন গণ্ডগোল পাকিয়ে গেল। টিকটিকিটা হঠাৎ কেমন ফুলেফেঁপে উঠছে। ঠিক যেন একটা বেলুন। পরমুহূর্তেই হাওয়ায় একটা ডিগবাজি খেয়ে চারটে পা শূন্যে তুলে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল। মার্কামারা হয়েও এর আগে কখনো কোন শিকারকে এহেন আচরণ করতে দেখেনি সাপটি। রীতিমত সন্ত্রস্ত হয়ে সে যে পথে এসেছিল, সে পথেই ফিরে গেল। টিকটিকিটা বিপদ কেটে গেছে বুঝে আবার সোজা হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে এল। হর্ণড লিজার্ড (horned lizard) – এই টিকটিকিটির নাম। গায়ে শিং না থাকলেও পুরু কাঁটার বর্ম আছে – যার থেকেই এই নামকরণ। মাথার পিছনটা দেখার মত। লম্বা কাঁটাযুক্ত একটা চ্যাটালো বর্ম বেরিয়ে আছে সেখান থেকে। খানিকটা স্পিলবার্গের ‘জুরাসিক পার্ক’-এ দেখানো ট্রাইসেরাটপসের (triceratops) মত। কাঁটাগুলো আসলে তীক্ষ্ণ, লম্বা আঁশ। হর্ণড লিজার্ডের ‘হর্ণ’ কথাটা অবশ্য আরেকটা কারণেও মানানসই। মাথার উপর যে কাঁটা আছে, পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তা দিয়ে এ প্রায় দেড় পাউণ্ড শক্তি উৎপাদন করতে পারে – যা তার নিজের ওজনের প্রায় সাত গুণ। এটাও আরেকটি পরীক্ষালব্ধ ফল, যে হর্ণড লিজার্ড ক্ষিপ্রগতিতে শিকার করতে সক্ষম। এর খাদ্যতালিকায় রয়েছে বিষাক্ত হার্ভেস্টার অ্যান্ট (harvester ant)। পিঁপড়ে-উপনিবেশের কাছাকাছি বসে থেকে এই টিকটিকি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে (প্রায় ২২ মাইল/ঘন্টা) মুখ চালাতে থাকে। ওদিকে পিঠে কঠিন বর্ম থাকায়, পিঁপড়েরা শিকারীর চামড়ার ভিতর দাঁত ফোটাতেও পারে না। লড়াইটা হয়ে যায় একপাক্ষিক। এবার আসল কথায় আসি। হর্ণড লিজার্ডের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার আত্মরক্ষার বিভিন্ন কৌশল। তার একটা তো শুরুতেই বলেছি। ওই ডিগবাজি খাওয়া ছাড়া আরেকটা উপায় হল ‘ক্যামোফ্লাজ’। উত্তর আমেরিকাস্থিত অ্যারিজোনা, ইউটা ইত্যাদির মরু অঞ্চলের রুক্ষ জমিতে এরা পরিবেশের সাথে মিশে গিয়ে সহজেই আত্মগোপন করতে পারে। এর ফলে শিকারী পাখিদের চোখের আওতায় চট করে পড়ে না। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে সর্বশেষ উপায়টি হল হর্ণড লিজার্ডের তুরুপের তাস। অন্য আর কোন জীবের দ্বারা হয়ত এটি সম্ভব না। সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর লেখনীর অনুকরণে হয়ত বলা যায় রক্তক্ষরণে রক্ষাকরণ। কৌশলটি হল শিকারীর মুখে নিজের শরীরের রক্ত ছিটিয়ে তাকে নাকাল করা। কুকুর, কয়োটি (coyote) বা অন্যান্য শ্বাপদের হাত থেকে রেহাই পেতে গেলে আগের দুই কেরামতি খুব একটা কার্যকরী নয়। এই হেতু নতুন পন্থা অবলম্বন। কোন কারণে বিপন্ন বোধ করলে, হর্ণড লিজার্ড নিজের মস্তিষ্ক অঞ্চলে রক্তপ্রবাহ স্তিমিত করে দেয়। এর ফলে ওই জায়গায় রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং চোখের নিকটস্থ ছোটছোট রক্তবাহিকাকে বিদীর্ণ করে রক্ত বেরিয়ে আসে বিদ্যুদ্বেগে। ঠিক যে ভাবে দমকলকর্মীরা হোসপাইপ দিয়ে ‘ওয়াটারজেট’ বর্ষণ করে। চোখের পেশীর সাহায্যে এই সরীসৃপ নিক্ষিপ্ত রক্তধারার দিক নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। হার্ভেস্টার পিঁপড়ে খাওয়ার ফলে পিঁপড়ের মধ্যেকার বিষ টিকটিকির রক্তেও বর্তমান। ফলে রক্তের স্বাদ ও গন্ধ খুবই উগ্র ও কটু হয়। তা যখন শিকারী শ্বাপদের মুখে ছেটে, সে ভয়ে, বিরক্তিতে সেখান থেকে পালায়। টিকটিকিটিও সে যাত্রা রেহাই পায়। হিসেব করে দেখা গেছে, প্রায় পৌনে পাঁচ ফুট অবধিও রক্ত ছেটাতে পারে এই অদ্ভুত প্রাণীটি – যা তার নিজের দৈর্ঘের প্রায় ন’গুণ। তাই এবার থেকে যে টিকটিকিটা রোজ সন্ধেবেলায় ঘরে এসে খাবার খোঁজে, তাকে একটু সমীহ করে চলাই যায়। তার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়টি যে বেশ কেউকেটা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen + six =