
মাকড়সারা যখন জাল তৈরি করে, তখন তারা তাদের পিছনের পা দিয়ে রেশমের সুতো টেনে বের করে। এই টানার কাজটা কিন্তু শুধু সুতো বের করাই নয়, এটি সুতোকে আরও শক্তিশালী করে তোলে, যাতে জাল সহজে ছিঁড়ে না যায়।
একটি নতুন গবেষণায়, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন
, এই টানার কারণে রেশমের ভেতরের প্রোটিন শৃঙ্খলগুলো সোজা হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হয়। এতে সুতো আরও মজবুত ও টেকসই হয়। সহজভাবে বললে, টানার কাজটা মাকড়সার রেশমকে শক্তিশালী করে যাতে জাল দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে।
এরপর গবেষকরা কম্পিউটার নকশার পূর্বাভাসগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পরীক্ষাগারে বিশেষভাবে তৈরি মাকড়সার রেশম ব্যবহার করে গবেষণা চালান।এই গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে এমন কৃত্রিম রেশম তৈরি করা যেতে পারে, যা দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তৈরি করা সম্ভব হবে, যেমন অস্ত্রোপচারের জন্য শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব সেলাই সুতো এবং বিস্ফোরণ-প্রতিরোধী বর্ম। এই গবেষণাটি ৭ মার্চ, শুক্রবার সাইন্স এডভান্সেস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।গবেষণার প্রধান সিনান কেটেন বলেছেন, “আমরা আগেই জানতাম যে টানার মাধ্যমে মাকড়সার রেশম শক্তিশালী হয়। কিন্তু কেন হয়, তা এতদিন পরিষ্কার ছিল না। বিজ্ঞানীরা কম্পিউটার নকশার সাহায্যে খুব ছোট ন্যানোস্কেলে সংঘটিত পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করেছেন । এটি গবেষকদের নতুনভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে, কীভাবে টানার প্রক্রিয়া রেশমের শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়।
নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জ্যাকব গ্রাহাম জানিয়েছেন, মাকড়সারা স্বাভাবিকভাবেই এই টানার কাজটি করে। যখন তারা তাদের দেহের রেশম গ্রন্থি থেকে সুতো বের করে, তখন পিছনের পা দিয়ে সেটি টেনে নিয়ে যায়। এই টানার ফলে সুতো তৈরি হওয়ার সময়ই লম্বা, শক্তিশালী এবং স্থিতিস্থাপক হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, টানার মাত্রা বদলানোর মাধ্যমে রেশমের শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা পরিবর্তন করা যায়। গবেষকরা মাকড়সার রেশম নিয়ে অনেক দিন ধরে গবেষণা করছেন, কারণ এটি খুবই শক্তিশালী।এটি ইস্পাতের র চেয়েও শক্ত, কেভলারের চেয়েও মজবুত এবং রাবারের মতো প্রসারিত। তবে মাকড়সার কাছ থেকে প্রাকৃতিক রেশম সংগ্রহ করা ব্যয়বহুল ও বেশ কঠিন কাজ। তাই বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে মাকড়সার রেশমের মতো উপাদান তৈরি করার চেষ্টা করছেন।
গবেষক জ্যাকব গ্রাহাম বলেন, “মাকড়সার রেশম হলো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাকৃতিক সুতো।এটি সহজেই পচে যায়, তাই পরিবেশে জন্যও ভালো। এটি অস্ত্রোপচারের সেলাই সুতো ও ক্ষত বন্ধের জন্য বিশেষ ধরনের আঠা তৈরির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ এটি শরীরে স্বাভাবিকভাবে মিশে যাবে এবং কোনো ক্ষতি করবে না।গবেষণার সহ-লেখক ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
ফুজং ঝাং কয়েক বছর ধরে জীবাণু ব্যবহার করে মাকড়সার রেশমের মতো উপাদান তৈরি করার কাজ করছেন। তার দল বিশেষভাবে তৈরি রেশম প্রোটিন বের করে এনে হাতে টেনে প্রসারিত করেছেন। যার ফলে তাঁরা এমন কৃত্রিম সুতো তৈরি করতে পেরেছেন, যা গোল্ডেন সিল্ক অরব উইভার নামের বড় মাকড়সার সুতোের মতোই শক্ত ও টেকসই।
গবেষকরা কৃত্রিম রেশম তৈরির পদ্ধতি বের করলেও, এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেননি মাকড়সার জাল তৈরির প্রক্রিয়া কীভাবে সুতোকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই রহস্য সমাধান করতে, গবেষক কেটেন ও গ্রাহাম কম্পিউটার নকশা ব্যবহার করে কৃত্রিম রেশমের ভেতরের পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষকরা কম্পিউটার নকশার সাহায্যে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন যে টানার ফলে রেশমের ভেতরের প্রোটিনগুলো কীভাবে সাজানো হয়। পরীক্ষায় তারা দুটি বিষয় খুঁজে পান। প্রথমত টানার ফলে প্রোটিনগুলো সোজা হয়ে একসারিতে চলে আসে, যা সুতোকে আরও শক্তিশালী করে। দ্বিতীয়ত
প্রোটিন শৃঙ্খলের মধ্যে হাইড্রোজেন বন্ধন বাড়তে থাকে, যা সুতোকে আরও মজবুত, শক্তিশালী প্রসারিত করে।গবেষক গ্রাহাম জানান প্রথমে রেশম খুব একটা শক্তিশালী হয় না। কিন্তু যদি এটিকে ছয় গুণ পর্যন্ত টানা হয়, তাহলে এটি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়।গবেষকরা তাঁদের কম্পিউটার নকশার তথ্য সত্যি কিনা তা যাচাই করতে বিশেষ ধরনের স্পেকট্রোস্কপি
পরীক্ষার মাধ্যমে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি রেশমের ভেতরের প্রোটিন শৃঙ্খলাগুলি দেখেন। তাঁরা আরও পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করেন যে , সুতো কতটা টান সহ্য করতে পারে ও ছিঁড়ে যাওয়ার আগে কতটা প্রসারিত হয়। পরীক্ষার ফলাফল কম্পিউটার নকশার পূর্বাভাসের সঙ্গে মিলেছে।গবেষক গ্রাহাম বলেন, যদি রেশম টানা না হয়, তাহলে প্রোটিনগুলো ছোট ছোট গোলাকার গুচ্ছের মতো থাকে। কিন্তু যখন টানা হয়, তখন এগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শক্তিশালী একটি জাল তৈরি করে। প্রোটিন শৃঙ্খলগুলো একটার ওপরে আরেকটা জমে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। এই গুচ্ছ আকারে থাকা প্রোটিনগুলো টানার ফলে প্রসারিত হয়, যা সুতোকে আরও শক্তিশালী ও মজবুত করে। তবে, যদি প্রোটিনগুলো আগে থেকেই লম্বা থাকে, তাহলে সেগুলো তুলনামূলকভাবে কম প্রসারিত হয়, কিন্তু ছিঁড়তে বেশি শক্তি লাগে।
গবেষক আগে গ্রাহাম মনে করতেন মাকড়সা শুধু বিরক্তিকর একধরনের প্রাণী।কিন্তু এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন, মাকড়সার রেশম আমাদের অনেক কাজে লাগতে পারে। কৃত্রিমভাবে তৈরি মাকড়সার রেশম সাধারণ প্লাস্টিকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী এবং সহজেই পচনশীল ও পরিবেশ বান্ধবও । তিনি বলেন, আগে মাকড়সাকে বিরক্তিকর মনে হলেও এখন তিনি তাদের আশ্চর্যজনক প্রাণী মনে করেন মনে করেন।এই গবেষণার শিরোনাম ছিল “কৃত্রিম রেশম কতটা শক্তিশালী হতে পারে তা বোঝার জন্য টানার প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ।” এটি জাতীয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে।