সাক্ষাৎকার/8

সাক্ষাৎকার/8

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২ অক্টোবর, ২০২১

মনন ও বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ

(বিশিষ্ট পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানলেখক, এবং ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক পলাশ বরন পালের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানভাষ-এর প্রধান সম্পাদক ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরী)

ডঃ চৌধুরী। আমরা কথা বললাম স্কুলে বিজ্ঞানশিক্ষায় ভালো ছেলের তত্ত্ব এবং পয়সা দিয়ে পড়াশুনো করা, অর্থাৎ পড়াশুনো কেনা, যেটা এই দেশে হিড়িক পড়ে গেছে এখন, সে ব্যাপারে আপনি আপনার মতামত জানালেন, আমি শুধু বিজ্ঞানভাষ-এর পক্ষ থেকে বলতে চাই যে আমরা একশো পঞ্চাশ ভাগ সহমত, যদি একশো পঞ্চাশ ভাগ বলে কিছু থেকে থাকে, এত ভাল্লাগছে আপনার মতন একজন গবেষক বিজ্ঞান, চিন্তক ব্যক্তি এই বিষয়টাকে এভাবে উপস্থাপিত করলেন বলে।
আমরা স্কুলে বিজ্ঞানশিক্ষার যে প্রশ্নটাতে আসছিলাম, আসতে আসতে অন্য প্রশ্নে গেলাম, সেটা হচ্ছে আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষায় গেলানোর একটা তত্ত্ব থেকে যায়। কীভাবে প্রশ্ন তোলা এবং তর্ক করা, সেইটাকে কীভাবে উৎসাহিত করা যেতে পারে, শিক্ষকদের কাছে এটা–
অধ্যাপক পাল। হ্যাঁ এইটা আপনার তিনটে বিষয়ের মধ্যে ছিল, এবার সে ব্যাপারে কথা বলা যাক।
দেখুন, প্রশ্ন তোলা, তর্ক করা যে শুধু বিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজন তা নয়। সমস্ত কিছুর জন্য প্রয়োজন। শিখতে গেলেই প্রশ্ন তুলতে হয়, তর্ক করতে হয়। আবার এটাও ঠিক যে কিছু কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়, আবার সেগুলো কেন মেনে নিতে হবে, সেটা সম্বন্ধে একটা ধারণা থাকাও দরকার। যেমন সতেরো ঘরের নামতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যে কোনও মানে হয় না, [আর] কেন মানে হয় না সেটাও বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। এটা যে কতগুলো সংখ্যা— এইভাবে তার পরিচয়। একজনের নাম যেমন কেন পলাশ, কেন এর নাম অভিজিৎ, এটা নিয়ে যেমন চিন্তা করে কোন লাভ নেই, এটা কতগুলো বোঝাবার জন্য নাম বলা যেতে পারে, এখন সেইরকম জিনিসও রয়েছে যেগুলো জানতে হয়। কিন্তু তার বাইরে প্রশ্ন সবকিছুতেই তুলতে হয়। আমি তো বলব বিজ্ঞানের চেয়েও অনেক বেশি প্রশ্ন তুলতে হয় যারা ধরুন পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ে, তাদের প্রশ্নের পরিমাণ আরও হয়তো বেশি থাকে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কিছু কিছু জিনিস যেমন ধরুন নিউটনের গতিসূত্র মেনে আমাদের এগোতে হবে, এর পরে কীভাবে এর প্রয়োগ হচ্ছে সে ব্যাপারে তুমি কথা বলো, কিন্তু কতগুলো জিনিস না মানলে তুমি কিছুই করতে পারবে না।
কাজেই প্রশ্ন তোলা ব্যাপারটা সমস্ত বিষয়ের জন্যেই প্রয়োজন। এখন আমাদের দেশের ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে সমস্ত দেশেই আছে কিছু না কিছু পরিমাণে, আমি আমার ছেলেকে বা মেয়েকে এটা বললাম যে আমি বলছি অতএব তোমায় মানতে হবে, এই জিনিসটা আমাদের মধ্যে একটু বেশিই আছে, যার জন্য আমরা হয়তো একটু কম কথা বলি, আর সব জায়গায় ফরফর করে কথা বলাটাও যে খুব একটা বাহাদুরির পরিচয় তাও নয়। মানে প্রশ্ন করতে হবে বলেই যে অনেকে অকারণে এমন প্রশ্ন করে যেগুলোর কোনও মানে হয় না। কিন্তু হ্যাঁ, এর মধ্যে একটা মাঝামাঝি জায়গায় থাকতে হবে। প্রশ্ন করতে কোনও ছাত্র বা ছাত্রী যেন দ্বিধা বোধ না করে। যিনি শিক্ষক তাঁকে এইরকম একটা, তাঁর নিজের পরিচয় দিচ্ছেন, তাঁর নিজের সম্বন্ধে এইরকম একটা বোধ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তৈরি হতে হবে, যে এঁকে একটা প্রশ্ন [করতে ইচ্ছে হলে] প্রশ্নটা করা যাবে। আর শিক্ষক যদি প্রশ্ন করলেই বলেন, এই চুপ করে বসে থাকো, বাজে বকবক কোরো না— তাহলে সেটা খুবই খারাপ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, এখন আমাদের ছোটবেলার পরেও এই জিনিসটা অনেকটাই বদলেছে। এখন কোনও শিক্ষক কি ঠিক এইভাবেই কথা বলেন, সেই বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন; এইরকমভাবে পড়াশুনো এখন কোথাও হয় না। সুতরাং ছাত্রদের পক্ষে অনেক বেশি প্রশ্ন করা সম্ভব। তবে সারাক্ষণ ফরফর করে প্রশ্ন করার চেয়ে একটু মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করাটাও দরকার। যেমন যখন আপনি গোয়েন্দা গল্পের সিনেমা দেখছেন, মানে আপনি যদি তের নম্বর পাতায় প্রশ্ন করতে শুরু করেন কেন এটা করল, এখন সেরকম ব্যাপার বিজ্ঞানের মধ্যেও কিছুটা থাকে, সেই জিনিসটা পরে বোঝা যাবে। সেটা যদি কারও প্রশ্ন ওঠে, সেটা করাটা অন্যায় নয়, কিন্তু সে ক্ষেত্রে শিক্ষককে বলতে হবে, ঠিক আছে তুমি প্রশ্নটা করলে, ভালো প্রশ্ন, মনে রাখো, দ্যাখো আধ ঘণ্টা পরে আমি ঠিক এই প্রশ্নটারই জবাব দেব। কিন্তু একটু প্রস্তুতির দরকার আছে, সেটা না হলে এই জবাবটায় আসছি না। তাহলেই মিটে গেল।
আর একটা জিনিস যেটা বলা হয় আমাদের শিক্ষা সম্বন্ধে, লোকের বা ছাত্রছাত্রীদের যে বিজ্ঞান চেতনার যথার্থ বিকাশ হয় না। যেটা আপনি বললেন যে খানিকটা গিলিয়ে দেওয়ার মতো হয়। দেখুন এই গিলিয়ে দেওয়ার একটা কারণ হচ্ছে যে আমাদের যে পাঠ্যক্রম, সেখানে অত্যাধিক পরিমাণে জিনিস শেখানো হয়। মানে একটা ক্লাস এগারো বা বারোর ছাত্রছাত্রীকে অক্সালিক অ্যাসিড কী করে বিক্রিয়া করে সেটা জানতে হবে, এটা আমার কোনও দিন মাথায় ঢোকে না। অবশ্যই যে রসায়ন শাস্ত্রে বিএসসি বা এমএসসি করবে তাকে পড়তে হবে, কিন্তু একটা এগারো বা বারোর ছাত্রছার কাছ থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করি এটাই পরিষ্কার নয়। নিউক্লিয় বিক্রিয়া কী করে হয় এটা একটা এগারো বারোর ক্লাসের ছাত্রর না জানলেও চলবে। কিন্তু এই ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট করে ভেবে দেখা হয় না। সম্প্রতি আমি একটা সিলেবাস কমিটিতে ছিলাম, কোন জায়গা সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, সেখানে আমাকে প্রথমেই বলা হয়, মানে যাঁরা নতুন সিলেবাসের প্রস্তাব দিচ্ছেন, তাঁরা বললেন যে আমরা কিছু কিছু জিনিস সিলেবাসে যোগ করেছি, সেই জিনিসগুলো হচ্ছে এই, আমি বললাম, বেশ, এখন কী কী জিনিস বাদ দিয়েছেন সেগুলো বলুন। তাঁরা বললেন না সেরকম কিছু তো বাদ দেওয়া হয়নি। আমি বললাম, তাহলে যোগ করেছেন কেন। আগে বাদ দিন, তারপরে যোগ করুন। ক্রমাগত চাপিয়ে যাবেন চাপিয়ে যাবেন এভাবে তো হয়না। গাধার ওপরে বোঝা। একজন ছাত্র বা ছাত্রী কী শিখতে চাইবে, কতটা শিখতে চাইবে, কতটা শিখলে সে আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারবে সেটা তো বুঝতে হবে।
আমাদের সিলেবাস অত্যাধিক ভারী, কোনও মানে হয় না। আমি এম এস সি সিলেবাসের কথা বলছি না, আমি স্কুল পর্যায়ের ইলেবাসের কথা বলছি, এই সিলেবাস হলে গেলার প্রবণতা একটু বেড়ে যায়।
কিন্তু বিজ্ঞান চেতনার যে কথাটা বলা সেইটার মধ্যে তারা বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে কোনও কিছু ভাবতে চায় না, সেই কথাটা আমার কাছে খুব কী বলব, খুব সম্মত বলে মনে হয় না। ইশকুলে ইউক্লিডের জ্যামিতি পড়ানো হয়। একে কী বলব, যুক্তিবাদের একটা উচ্চতম শৃঙ্গ বলা যেতে পারে। আমি চারটে পাঁচটা জিনিস ধরে নিলাম, তার থেকে সবকিছু আমি যুক্তি দিয়ে দিয়ে বার করছি। ত্রিভুজের কোণ সমষ্টি একশো আশি ডিগ্রি, এটা আমি ধরে নিইনি, এটা ওই চারটে পাঁচটা জিনিস ধরে নিয়ে তার থেকে বার করেছি। কাজেই এই যে কতগুলো জিনিস ধরে নিয়ে তার থেকে যে যুক্তি বিস্তার করে অন্য জিনিসে পৌছনো যায়, এটা ইউক্লিডের জ্যামিতি পড়ানোর থেকেই ছাত্রদের এই বোধটা আসা উচিত। যে যুক্তি এইভাবেই বিস্তার করতে হয়। যে বোধটা হয়তো অত পরিষ্কারভাবে বলা হয় না, সেটা হয়তো বলা যেতে পারে। সেটা হচ্ছে যুক্তি দু-রকমের হয়। একটা হচ্ছে আরোহী যুক্তি, অন্যটা অবরোহী যুক্তি। এখন ইউক্লিডের যুক্তি হচ্ছে অবরোহী যুক্তি। অর্থাৎ আমরা প্রথমেই কতগুলো জিনিস ঠিক করে নিলাম, এবার তা থেকে আমরা সোপান বেয়ে বেয়ে দেখব যে কোথায় কোথায় পৌছনো যায়। আর আরোহী যুক্তিতে আমাকে প্রথমেই একটা ঘটনা দিয়ে দেওয়া হল, এইবার আমি সেই ঘটনাটাকে ব্যাখ্যা করবার জন্য কী যুক্তির প্রয়োজন সেটা দেখব। আমার যা যুক্তির দরকার হয় সেগুলোকে আহরণ করতে শুরু করব।
যেমন ধরুন আমাকে বলা হল যে রোদ্দুরে ভিজে জামাকাপড় তাড়াতাড়ি শুকোয়। এইটে আমরা যে কেউ দেখি চোখের সামনে। কেন হয়?
এখানে ঘটনাটা আমাদের দেওয়া হয়েছে, আমাদের ঠিক করতে হবে যে কোথা থেকে শুরু করে এই ঘটনায় পৌঁছব। এখন এই আরোহী যুক্তি এইভাবে মানে ইউক্লিডের জ্যামিতির মতো করে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারণ এই যুক্তির চরিত্রটাই আলাদা। জীবনের অনেক ঘটনাই আমরা প্রত্যক্ষ করি যেগুলোকে এরকম আরোহী যুক্তির মাধ্যমে আমাদের ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়, বা প্রয়োজন না হলেও অন্তত বলা উচিত যে আমাদের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা উচিত। সেইগুলোয় আমাদের একটু সচেষ্ট হতে হবে, আর সচেষ্ট হওয়ার জন্য ইশকুলের শিক্ষকদেরকেও চেষ্টা করতে হবে। আমি যেমন আমার কাছে যারা গবেষণা করতে আসে সেইরকম ছাত্রদেরও বলি, পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক গবেষণা করলে বিভিন্ন জিনিসের পরিমাপের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবে, আর পরীক্ষামূলক গবেষণা করলে সেই পরিমাপগুলো করবারও চেষ্টা করবে। কিছু একটা তো করতে হবে। এখন নানানরকম পরিমাপ তো তোমরা রোজ চোখের সামনে দেখছ, সেগুলো নিয়ে কখনও ভেবেছ?
ধরো একটা ট্যাক্সিতে যে মিটার ওঠে, কী করে সে ট্যাক্সি বোঝে সে কতটা যাচ্ছে? কখনও ভেবে দেখেছ? ধরো তোমার ঘরের ভেতরে একটা যে আলোটা আছে, সে আলোটায় লেখা আছে যে চল্লিশ ওয়াটের আলো। কী করে আমরা জানব যে সেটা চল্লিশ ওয়াটের আলো, কোনওদিন ভেবে দেখেছ?
মানে এই যে নানান রকম প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগা চারপাশের জিনিস দেখে, এতে ছাত্রছাত্রীদের এই যে যুক্তি বোধ, এই আরোহী যুক্তির বোধ আরও দৃঢ় হয়, এবং সেইটা যাতে হয় তার জন্য এইরকম সহজ সহজ প্রশ্ন শিক্ষকদের করা উচিত ছাত্রদের সামনে।
এখন এইটা বলবেন যে এগুলো তাহলে পাঠ্য বইয়ের মধ্যে থাকছে না কেন। এখন সবকিছুই পাঠ্য বইয়ে থাকে না, এর বাইরে থেকেই কিছু শিখতে হয়। এই বোধটাও থাকা জরুরি, প্রয়োজনীয়। মানে তোমার বাবা যদি একটা ভুল কথা বলে, তাহলে তুমি বাবাকে থাপ্পড় মারবে না, এটা পাঠ্য বইতে লিখে রাখতে হয় না; জীবন থেকে জানতে হয়। কাজেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা প্রশ্ন করতে শিখিনি, কে প্রশ্ন করতে বারণ করেছিল? প্রশ্ন করতে চেষ্টা করো, তাহলেই হবে। প্রশ্ন করিবার উপায়, এর জন্য কি একটা সাব্জেক্ট তৈরি করে দিতে হবে? প্রশ্ন করিবার উপায়, এতে হায়ার সেকেন্ডারিতে পঞ্চাশ নম্বর থাকিবে, এইটা বলবার কোনও মানে হয় না। প্রশ্ন করতে শেখো, নিজে নিজে ভাবো, সেইটা ভাববার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে তোমার চারপাশে যে জিনিসগুলো ঘটছে, সেই জিনিসগুলো কেন ঘটছে, কীভাবে ঘটছে, নিজেকে আগে প্রশ্ন করতে হবে, তবে তো অন্য কাউকে প্রশ্ন করতে পারবে।