
প্রাণীদের চেহারা নিয়ে ভাবলে তাদের অদ্ভুত রঙের প্রসঙ্গই সবার আগে মাথায় আসে। আমরা মানুষরা বর্ণালীর একটি নির্দিষ্ট অংশই খালি চোখে দেখতে পাই। বেগনি পারের আলোর পরিসর কিন্ত অনেক প্রশস্ত। সেই পরিসরের বাকি রংগুলি মানুষের চোখে না পড়লেও, অনেক প্রাণীই দৈনন্দিন জীবনে তাকে ব্যবহার করে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণা, সাপের জীবনে অতিবেগুনি রঙের গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
“বিভিন্ন পাখি, ফুল এবং প্রজাপতি দেখে আমাদের আপাত উজ্জ্বল এবং রঙিন মনে হলেও, গবেষণার অনেকাংশই কিন্তু মানুষের রঙ উপলব্ধি দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট”, বলেছেন হেইলি ক্রোয়েল। অর্থাৎ গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই মানুষের উপলব্ধি ব্যতীত আর কোনো রঙ আমরা সনাক্ত করতে অক্ষম। ক্রোয়েল উল্লেখ করেছেন, পূর্বের গবেষণাগুলি অনেকটাই অতিবেগুনি রংয়ের সঙ্গে প্রজননের সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছিল। কিন্তু সাপ সাধারণত সঙ্গী খুঁজতে উজ্জ্বল রঙের উপর নির্ভর করে না। বিজ্ঞানীদের অনুমান, তারা হয়তো বেশিরভাগই পরিবেশের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতে কিংবা সংকেত আদান-প্রদান করতে এই রং ব্যবহার করে থাকে।গবেষকরা কলোরাডো থেকে পেরু পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ১১০ রকম সাপের প্রজাতি বিশ্লেষণ করেছেন। এদের মধ্যে অনেকগুলি প্রজাতি মানুষের অ-দেখা বেগুনি পরের রশ্মি দেখতে এবং কাজে লাগাতে পারে। একটি বিশেষ ক্যামেরা লেন্স এবং ফিল্টার ব্যবহার করে, তাঁরা সাপের ছবি তুলেছেন, অতিবেগুনি প্রতিফলন-নমুনা দেখেছেন। এক্ষেত্রে তাঁরা ফ্লুরোসেন্স (স্বয়ংদীপ্তি ) ছাড়াই সাপ স্বাভাবিকভাবে যে অতি বেগুনি রঙ প্রতিফলিত করে, যা মানুষের চোখে অদৃশ্য, সেই রঙগুলোই দেখেছেন। পাতা, লাইকেন (গাছের শ্যাওলা) এবং অন্যান্য উদ্ভিদ সবই অতিবেগুনি আলো প্রতিফলিত করে। সুতরাং, অতিবেগুনি রং প্রদর্শনকারী একটি সাপ সূর্যালোকিত বাসস্থানে নিখুঁতভাবে পরিবেশের সাথে মিশে যেতে পারে। তবে খুব অদ্ভুত ব্যাপার এই যে পুরুষ ও স্ত্রী সাপের মধ্যে অতিবেগুনি ছাঁচগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা ছিল না। “যেহেতু প্রজননক্রিয়া অনেক অন্য প্রজাতিতে অতিবেগুনি রঙের বিবর্তন ঘটায়, তাই সাপের মধ্যে লিঙ্গভেদে এই পার্থক্যের অভাবটা আশ্চর্যের,” বলেছেন গবেষণাপত্রের সহ-লেখক অ্যালিসন ডেভিস রাবোস্কি। তিনি আরো বলেন, এটি হয়তো কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, হয়তো এটি পূর্বের গবেষণাগুলির অতিবেগুনি রং ঘটিত সীমাবদ্ধতাকেই প্রকাশ করে। সাপ, গিরগিটি প্রজাতির নিকট আত্মীয়। অথচ গিরগিটি প্রজাতিগুলির পুরুষদের প্রায়ই স্ত্রীদের তুলনায় বেশি চকচকে রঙ বা বড় অলঙ্কার থাকে। বিপরীতে, সাপের মধ্যে লিঙ্গভেদে রঙের পার্থক্যের অভাব প্রমাণ করে যে যৌন নির্বাচনে সাপ, তাদের গিরগিটি আত্মীয়দের মতো রঙের পার্থক্য সৃষ্টি নাও করতে পারে। গবেষকরা আরও দেখেছেন যে একই প্রজাতির, একই লিঙ্গের এবং একই স্থানের কিছু সাপ অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিফলন স্তরে নাটকীয়ভাবে ভিন্ন হতে পারে।
দুটি সাপ দৃশ্যমান বর্ণালীতে প্রায় একই রকম দেখাতে পারে। কিন্তু একটি জোরালো ভাবে অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিফলিত করে, অন্যটি করে না। রঙ ব্যবহারের এই জটিলতা মানুষ খালি চোখে দেখতে পায় না। তাই এই পার্থক্যের কারণগুলিও অস্পষ্ট থেকে যায়। এছাড়া সাপের বয়স, লিঙ্গ, বাসস্থান, বিবর্তনীয় পটভূমি এবং শিকারীদের কাছে সাপটি কতটা দৃশ্যমান – এগুলিও বেশি বা কম অতিবেগুনি রঙের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত হতে পারে তা পরীক্ষা করেছেন তাঁরা। তাদের কাছে সবথেকে বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হল, সাপের বাসস্থান তাদের অতিবেগুনি রশ্মির সবথেকে বড় চালক। যেসব সাপ বেশিরভাগ সময় গাছে কাটায় এবং রাতে সক্রিয় থাকে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিফলন হয়েছিল। “পাখিরা সবথেকে বড় সাপ শিকারি। এরা অতি বেগুনি রঙ দেখতে পায়। গাছে বসবাসকারী রাত্রিচর সাপের জন্য প্রচুর অতিবেগুনি প্রতিফলন রাতে গুরুত্বহীন হলেও, দিনের বেলা পাখিরা যখন সক্রিয়ভাবে শিকার করে, তখন সাপেদের গা ঢাকা দিতে সাহায্য করে। বিবর্তনের পথে কিছু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত প্রজাতিতে অতিবেগুনি প্রতিফলনের উপস্থিতি বা তীব্রতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এমনকি একই গোত্রের মধ্যে কিছু শক্তিশালী অতিবেগুনি প্রতিফলনকারী এবং কম প্রতিফলনকারী উভয় জনসমষ্টিই খুঁজে পাওয়া গেছে। নতুন গবেষণাটি এই ধারণাকে স্পষ্ট করেছে যে অদৃশ্য রংগুলি বিবর্তনীয় তথ্য বোঝার ক্ষেত্রে মানুষের কাছে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। সাপ যে প্রায়শই ঘাপটি মারার জন্য অতি বেগুনি রংগুলি ব্যবহার করে , যৌন নির্বাচনের জন্য নয় – তা প্রাণীজগতে রঙ কীভাবে ব্যবহৃত হয় সে সম্পর্কে ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এই গবেষণা, অন্যান্য কম অধীত প্রাণী গোষ্ঠীতে অতি বেগুনি রঙের ব্যবহার সম্পর্কে অনুসন্ধানকে উৎসাহিত করছে। বিশেষ করে যাদের মানুষ বর্ণহীন হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত।