সামাজিক নয় শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকুক

সামাজিক নয় শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকুক

সুমন প্রতিহার
Posted on ১৪ নভেম্বর, ২০২১

“মনে হয় এতটা পরিবর্তন না হলেই বোধ হয় ভালো হতো” সত্যজিৎবাবু নায়কের চিত্রনাট্যে অরিন্দমের মুখে কথাগুলো বসিয়েছিলেন। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক নায়কের আর্তনাদ। করোনা রোধেও কর্তব্য তালিকাতে প্রথম সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সামাজিক দূরত্ব বা সোশ্যাল ডিস্টেন্স ভারতবর্ষে মারাত্মক সংকট নামিয়ে আনতে যথেষ্ট। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশনের ওয়েবসাইট দেখাচ্ছে সামাজিক দূরত্ব ই নাকি শারীরিক দূরত্ব। বাস্তবে এই দুটো শব্দ যথেষ্ট প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বিস্তর বিড়ম্বনা। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সামাজিক ঘটনাপ্রবাহে বললেন করোনা ভাইরাসে ভর করে বিশ্বে ঘৃণার সুনামি চলছে।  ভারতবর্ষে করোনার নামে আক্রান্ত ও পরিবারকে সহজেই বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়েছে। গবেষণা বলছে প্রয়োজন শুধু শারীরিক দূরত্ব। হাঁচি-কাশির দ্বারা পাঁচ মাইক্রোমিটারের বড় ড্রপলেট এক মিনিটের কম সময়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে তবে ভাইরাস যদি এরোসলে ভর করে বসে তার স্থায়িত্বকাল নিয়ে সঠিক কিছু বলার সময় আসেনি, কিন্তু তেরো ফুট পর্যন্ত ভাসতে সক্ষম। মিসেল ভাইরাস বাতাসে দু ঘন্টা, ইনফ্লুঞ্জয়া ভাইরাস প্রায় এক ঘন্টা সক্রিয় থাকে কিন্তু মাম্পস ভাইরাসের শরীরের বাইরে স্থায়িত্ব খুব সময়ের জন্য। বায়ুপ্রবাহ আর্দ্রতা এমন কি কথা বলার তীব্রতা থেকে ব্যক্তির উচ্চতাও সংক্রমণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। করোণা ভাইরাসের উপস্থিতি মানব মল থেকে শুক্রাণু সর্বত্র তবে সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কোনো তথ্য নেই।

বঙ্গে বর্ষা প্রবেশের সঙ্গে আরও কিছু ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ে। শীতকালীন ভাইরাসগুলোর পরিচিত দাপট শুরু হবার সময়ও আসছে। করোনা, কমন কোল্ড, ফ্লু এর উপসর্গগুলোকে আলাদা করা যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। জ্বরের সঙ্গে শুকনো কফ ফ্লু ও করোনার উপসর্গ। আগত শীতকালে অন্যান্য নিয়মিত ভাইরাসের উপসর্গ প্রকাশের সময়ে কিভাবে সামাজিক দূরত্ব পালন করা হবে। জ্বর ও কাশির সাধারণ সমস্যা নিয়ে চলা মানুষকেও অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে।

করোনা পরবর্তী নতুন স্বাভাবিক নিয়মে প্রাত্যহিক জীবনে পরিবর্তন আনবে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা চলে কিন্তু তার স্থায়িত্ব কতদিন সেটি নিয়েও প্রশ্ন থাকবে। পয়লা বৈশাখ বাঙালি একলা যাপন করেছে সঙ্গে পঁচিশে বৈশাখের সকালটাও ভাইরাসের জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় ছিল। লকডাউন পরবর্তী সময়ে জাপান তিনটি “সি” থেকে কঠোরভাবে দূরে থাকার নিয়ম প্রবর্তন করেছে। ক্লোজড প্লেস, ক্রাওডেড প্লেস এবং ক্লোজড কন্টাক্ট। গবেষণা দেখিয়েছে বাতানুকূল অবস্থায় বদ্ধ স্থানে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রায় আঠারো শতাংশ বেশি।

সামাজিক দূরত্বের ছোবলে আজ শববাহী শকটও সংকটে। মৃত মানুষের শ্মশানে যাওয়ার মাধ্যম ময়লা ফেলার গাড়ি। মৃতদেহের সঙ্গে দূরত্ব রাখতে গিয়ে মানুষ অসংবেদনশীল হয়ে পড়ছে। যদিও শব দেহ থেকে করোনা সংক্রমণের কোন প্রমাণ বিজ্ঞানে অমিল। সাধারণ সর্দি-কাশি নিয়ে ঘরের বাইরেও সামাজিক বাধার সম্মুখীন এমনকি ঘরের মধ্যে কাশির শব্দে প্রতিবেশী গোপনে স্বাস্থ্য দপ্তরে ফোন করছেন। পরিশ্রান্ত পরিযায়ী শ্রমিক আজ সামাজিক দূরত্বের নিয়মে খোলা মাঠে, পরিত্যক্ত পোল্ট্রিতে এমনকি শৌচাগারে রাত্রি যাপন করতে বাধ্য হয়েছে। ভারতবর্ষের আই সি এম আর জানাচ্ছে আক্রান্ত রোগীর নব্বোই শতাংশ উপসর্গহীন আবার প্রতি একশো জনে সাতানব্বই জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে। আনলক প্রথম পর্বে কন্টেন্ট মেনট এলাকার সংঘা আমূল বদলে গেলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অপরিণত বিজ্ঞান লালন করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সামাজিক দূরত্ব শব্দবন্ধটি নিয়ে নিশ্চুপ। তারা বলছে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মধ্যে দিয়েই ভাইরাসের শৃংখল ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এই বছর কুড়ি মার্চ হু তাদের পরিকল্পনা স্পষ্ট বলেছে সামাজিক দূরত্ব প্রণয়নের মাধ্যমে মানুষকে সমাজকে থেকে দূর করতে তারা চায়না শুধু তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষে। ভারতবর্ষে করোনা আবহে ভয় সন্দেহ রূপে জমাট বেঁধে আছে, সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বাড়লে মানবতার অপূরণীয় ক্ষতি। নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেনিয়াল আলড্রিচ বলছেন সংকটকালে সামাজিক দূরত্বের বদলে পারস্পরিকতাকে ঝালিয়ে নেওয়ার সময়। আক্রান্ত রোগীর ঘরে বেল বাজিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী নামিয়ে দিয়ে আসার মধ্যে দিয়েই মানবতার উৎকর্ষ সাধিত হবে। সরকার ও প্রচার মাধ্যম যতই সামাজিক দূরত্বের নিয়মকে আকঁড়ে ধরুক মনকে অভিযোজিত করে শুনতে হবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথাই বলা হচ্ছে। জাতি, ধর্ম, বয়স, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে করোনা আক্রান্ত হতে পারে। প্রভেদটা ভাইরাস করেনা, আমরা আক্রান্তের সঙ্গে সামাজিক দূরত্বের নামে বিভদটা বাস্তবায়িত করছি। করোনা আক্রান্ত মানুষ সমাজে দ্রুত তার মূল্য হারাচ্ছে। করোনা উপসর্গ নিয়ে মানুষ সামাজিক দূরত্বের ভয়ে চিকিৎসা নিতেও বিলম্ব করেছে। ভারতবর্ষের করোনা কলঙ্ক পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হতে চলেছে। করোনার ক্ষত শরীর বহন করবে কিন্তু মানসিকভাবে করোনা কলঙ্ক যত শীঘ্র মিলিয়ে যায় মঙ্গল। সমকালে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই সামাজিক থাকার কৌশল গুলো রপ্ত করে নিতে হবে।