
রূপান্তরে ওস্তাদ দশভুজা সাগর জীব স্কুইড। নিমেষে ত্বকের রঙ পরিবর্তন করে পরিবেশে ঘাপটি দিতে পারে তারা। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যটি, তাদের শিকারীদের হাত এড়িয়ে পালাতে এবং নিজেদের শিকার ধরতে সাহায্য করে। এদের এই ক্ষমতা আজকের নয়, ডাইনোসরের যুগ থেকেই রয়েছে। তবে, বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও, এই ক্ষমতার পেছনের যান্ত্রিক অনেক বিষয়ই এখনও রহস্যময়। নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রসায়ন ও রসায়নিক জীববিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেইলা দেরাভি, তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণায় স্কুইডের ছদ্মবেশ ধারণের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুইডের একটি বিশেষ অঙ্গ রয়েছে, যা সৌর কোষের মতো কাজ করে। এর মধ্যে দিয়ে উৎপাদিত শক্তি, তাদের ত্বকের রং পরিবর্তনের জন্য শক্তি জোগায়। এই আবিষ্কার, এই মজার প্রাণীটিকে বুঝতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি মানুষের ব্যবহারের জন্য নতুন প্রযুক্তির উন্নয়নকেও প্রভাবিত করতে পারে। দেরাভি বছরের পর বছর স্কুইড, অক্টোপাস এবং কাটলফিশের মতো মোটা মাথার শুঁড়ওয়ালা সেফালোপডদের নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। ইদানীং তাঁর দল ক্রোমাটোফোরদের উপর মনোযোগ দিচ্ছেন। এটি এক বিশেষ রঙিন কাঠামো, যা স্কুইড-এর রঙ পরিবর্তনের ক্ষমতার কারণ। ক্রোমাটোফোরগুলি ছোট ছোট রঞ্জিত অঙ্গ, পেশী ফাইবার দ্বারা ঘেরা, নিউরনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এদের অবস্থান স্কুইডের ত্বকে । ফলত, প্রাণীটি তার পরিবেশের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চটজলদি থলিগুলি খুলতে এবং বন্ধ করতে পারে। আরেকধরনের ত্বক কোষ হল ইরিডোফোর। এর সঙ্গে কাজ করে ক্রোমাটোফোরগুলি একটি বিস্তৃত রঙের পরিসর তৈরি করে। একদিকে ক্রোমাটোফোরগুলিতে লাল, হলুদ এবং বাদামী রঞ্জক থাকে। অপরদিকে ইরিডোফোরগুলি সবুজ এবং নীল রঙ প্রতিফলিত করে। ফলে স্কুইড এক সেকেন্ডের একশো ভাগের মধ্যেই সম্পূর্ণ রঙের প্যালেট ছকে নিতে পারে। গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে, ক্রোমাটোফোরগুলি সূর্যালোক ও অন্যান্য আলোর প্রতি সংবেদনশীল। এই ক্ষমতা, স্কুইডকে বাইরের আলো ধারণ করতে এবং সেটিকে শক্তি হিসেবে সংগ্রহ করে রূপ পাল্টাতে সাহায্য করে।
এই তত্ত্বটি যাচাই করার জন্য, তাঁর গবেষণার দল একটি স্কুইড-চালিত সৌর সেল তৈরি করেছে। তাঁরা পরিবাহী কাচ, অর্ধপরিবাহী, ইলেকট্রোলাইট এবং স্কুইডের ক্রোম্যাটোফোর থেকে রঞ্জিত ন্যানোপার্টিকল ব্যবহার করে একটি বর্তনী বা সার্কিট তৈরি করেছেন। এই সার্কিট, আলোয় সাড়া দিতে সক্ষম। সার্কিটটিকে নকল সূর্যালোকের সামনে রেখে, তাঁরা শক্তির নির্গমন বা আউটপুট পরিমাপ করেছেন। ক্রোম্যাটোফোরগুলি কি সত্যিই বৈদ্যুতিক স্রোত উৎপন্ন করতে পারে ! “ক্রোম্যাটোফরের টুকরোগুলি প্রকৃতপক্ষে সূর্যের নকল আলোককে ভোল্টেজে রূপান্তর করছে, যা সার্কিট সম্পূর্ণ করতে পারছে। এমনকি সম্ভব হলে প্রাণীর শক্তি-উৎস হিসেবেও একে আহরণ করা যেতে পারে।” প্রথমবার, বিজ্ঞানীরা সেফালোপডের ক্রোম্যাটোফরকে শক্তি উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করে দেখলেন। রঙ অনুভব করা এবং সেগুলোকে শতকরা মিলিসেকেন্ডের মধ্যে বিতরণ করা যেন তাদের কাছে ছেলেখেলা! অবিশ্বাস্য! বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করে আসছেন, ক্রোমাটোফোরগুলি ডিজিটাল পিক্সেলের মতো কাজ করে। প্রয়োজন অনুযায়ী তারা রঙ প্রতিফলিত করে। তবে এগুলি কেবল রঞ্জক হিসাবে কাজ করে না – তারা সত্যিই আলো থেকে শক্তি অনুভব এবং উৎপন্ন করছে।
ডেরাভির গবেষণাগার ইতিমধ্যেই তাঁদের এই আবিষ্কারকে ব্যবহারিক কাজে লাগিয়েছেন। বিশেষত ত্বক ক্যান্সার প্রতিরোধে সানস্ক্রিন তৈরি করতে। তাঁর নতুন উদ্যোগ ‘সীস্পায়ার’, কিভাবে আরও পরিবেশবান্ধব এবং কার্যকর সানস্ক্রিন তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে তা নিয়ে অনুসন্ধান করছে। “স্কুইড হয়তো সত্যিকার অর্থে একটি ‘জীবন্ত ডিজিটাল ত্বক’ তৈরি করার চাবিকাঠি হতে পারে,” ডেরাভি বলেছেন। তিনি একটি ভবিষ্যতের চিত্র এঁকেছেন যেখানে পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি, স্কুইডের ত্বকের অভিযোজনকে নকল করবে। পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রতি সাড়া দেবে বিনা বাধায় এবং বড় ব্যাটারি বা জটিল সার্কিটের ওপর নির্ভর করা ছাড়াই। যেহেতু বিজ্ঞানীরা স্কুইডের রঙ পরিবর্তনের গোপন কথা উন্মোচনের কাজ অব্যাহত রেখেছেন, তাই তাঁদের আবিষ্কারগুলি রূপান্তরমূলক নতুন প্রযুক্তির দ্বার উন্মোচন করতে পারে। যার প্রেরণা জোগাবে প্রকৃতির নিজস্ব বিবর্তনীয় প্রতিভা।