অঙ্কের খেলা

অঙ্কের খেলা

১: অসীমবাবুর মেয়ের কাল রাত থেকেই জ্বর। জ্বরটা একটু অদ্ভুতই বলা চলে| টেম্পারেচারটা খালি কমছে, বাড়ছে| সকালেই উনি মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন| ডাক্তারবাবু কিছু ওষুধ দিয়েছেন আর বললেন টেম্পারেচারের একটা চার্ট বানাতে| প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর থার্মোমিটারে জ্বর মাপতে বলে দিয়েছেন| অসীমবাবু সকাল ১০টা থেকে টেম্পারেচার মাপা শুরু করলেন| তখন থার্মোমিটারে জ্বর দেখাল ৯৮-এর মতো, মানে জ্বর নেই বলা চলে| কিন্তু এরপরেই মেয়ের গা গরম হতে শুরু করল। হাত দিয়েই টের পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু যেহেতু ডাক্তারবাবু এক ঘণ্টা পরপর টেম্পারেচার মাপতে বলেছেন। তাই অসীমবাবু আবার সেই ১১ টায় থার্মোমিটার লাগলেন, কিন্তু ততক্ষণে মেয়ের শরীর আবার নরমাল টেম্পারেচারেই ফিরে এসেছে (৯৮.২-এর মতো)| জ্বরটা ঠিক এরকমই অদ্ভুত খাপছাড়া আচরণ করে চলল| প্রতি এক ঘণ্টা পরপরই কমে আসে, এদিকে মাঝের সময় বাড়তে থাকে| ৫ ঘণ্টা পর অসীমবাবু জ্বরের চার্টটার ছবি তুলে ডাক্তারবাবুকে পাঠিয়ে দিলেন| কিন্তু চার্টে তো টেম্পারেচার নর্মালই দেখাচ্ছে| তাই ভুল চিকিৎসা হবে বুঝতে পেরে অসীমবাবু ডাক্তারকে ফোন করে পুরো ঘটনাটা বললেন| শুনে ডাক্তারও অবাক হলেন আর অসীমবাবুকে বললেন আরও একটু ঘনঘন টেম্পারেচার নিতে, এবার আধঘণ্টা পরপর| কিন্তু কী তাজ্জব ব্যাপার, যেই অসীমবাবু আধঘণ্টা পরপর টেম্পারেচার মাপা শুরু করলেন তখন জ্বরটা টেম্পারেচার মাপার সময় গায়েব হয়ে গেল। কিন্তু মাঝের আধঘণ্টার প্রথম ১৫ মিনিটের মতো সময় ধরে বাড়তে থাকল। আর পরের ১৫ মিনিটে আবার কমে এল| তাই টেম্পারেচার চার্ট আবার ভুল তথ্য দিল| এবার রিপোর্টিংয়ের পর ডাক্তারবাবু বুঝতে পারলেন এটা সাধারণ কোনও জ্বর নয়, অন্য কোনো রোগের লক্ষণ, তাই বাড়িতে রেখে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব না| তিনি অসীমবাবুকে বললেন অবিলম্বে মেয়েকে কোনও হাসপাতালে ভরতি করতে, প্রয়োজন হলে ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে মেয়েকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখতে হবে।
ঘটনা ২: ইউনিভার্সিটিতে সারাদিন ধরে সেমিনার চলছে| স্যার,ম্যাডামরা সব ছাত্রছাত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন একমাত্র প্রকৃতির ডাক আর লাঞ্চ বা টিফিন-ব্রেক ছাড়া সারাক্ষণ সেমিনার হলেই বসে থাকতে হবে| অগত্যা সবাই বসে আছে| প্রত্যেকটি লেকচারের পর ছাত্রছাত্রীদের অ্যাটেনডেন্স নেওয়া হবে| কিন্তু কিছু চালাক ছেলেমেয়ে সেমিনার চলাকালীন বাইরে গিয়ে আড্ডা মারছিল। কিন্তু ঠিক অ্যাটেনডেন্স নেওয়ার সময়ই এসে অ্যাটেনডেন্স দিয়ে যাচ্ছিল।
এই দুটো ঘটনাই হয়ত কাল্পনিক। যাকে বলে ‘thought experiment’। কিন্তু একদমই অস্বাভাবিক বা অসম্ভব নয়, এরকম তো ঘটতেই পারে| বলতে পারেন এই ঘটনাদুটির মধ্যে মিলটা কোথায়? আর এ থেকে কি ইঙ্গিত পাওয়া যায়? দুটো ঘটনাই পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়, যে পদ্ধতিতে আমরা পরিমাপটা করছি সেই পদ্ধতিতে কখনওই সঠিক ফলাফলটা পাব না। পরিমাপের ফলাফল আর বাস্তবের মধ্যে ফারাকটা চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের সীমাবদ্ধতাটা দেখিয়ে দিচ্ছে| আমরা মাপামাপি করছি ঠিকই, কিন্তু যে সময় পরপর মাপছি সেই সময়টা আরো কিছুটা কমিয়ে আনতে হত| এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রথম ঘটনায় কত কম সময় পরপর টেম্পারেচার মাপা উচিত ছিল যাতে জ্বরের কমা-বাড়াটা ধরা পরে আর দ্বিতীয় ঘটনায় ঠিক কতক্ষন পরপর ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিটা মাপা উচিত ছিল যাতে কেউ পালাচ্ছে কিনা সেটা ধরা যায়| সত্যিই এর কোনো উত্তর আপনি পাবেন না| কারণ কি ধরণের জটিল শারীরিক সমস্যা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে হয়তো খুবই ঘনঘন শরীরের উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধি হতেই পারে| আবার প্রতি মুহূর্তেই সেমিনারে অংশগ্রহণকারী কেউ না কেউ হলে ঢোকা বেড়োনো করতেই পারে| তাই যে সময় পরপর টেম্পারেচার মাপছেন বা অ্যাটেনডেন্স নিচ্ছেন সেটা আপনি যতই কমিয়ে আনুন না কেন, কিছুতেই আপনি সঠিক তথ্য পাবেননা| আর তাছাড়া পরিমাপের জন্য যে পদ্ধতি আপনি ব্যবহার করছেন সেই পদ্ধতিতে অনির্দিষ্টভাবে এই সময়ের গ্যাপটাও কমিয়ে আনা সম্ভব নয় মোটেই| তাহলে এক্ষেত্রে কি করতে হবে বলতে পারেন? অবশ্যই এক্ষেত্রে এমন একটি পদ্ধতির কথা ভাবা দরকার যাতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে (continuous) পরিমাপ নেওয়া যায়| অসীমবাবুর মেয়েকে হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট-এ ভর্তি করলে সেখানে তার শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ, শরীরে শর্করার ওঠানামা বা এই ধরণের অন্যান্য শারীরবৃত্তিয় প্যারামিটারগুলি সর্বক্ষন ধরেই মাপার সুযোগ থাকবে| ঠিক সেরকমই দ্বিতীয় সমস্যাটিতে সেমিনার হলে যদি একাধিক সিসি-ক্যামেরা ইনস্টল করা যায় তবে নিরবিচ্ছিন্নভাবেই অ্যাটেনডেন্স ব্যাবস্থাটা চালু থাকবে, কোনো ব্যক্তিবিশেষকে আর এই কাজটি করতে হচ্ছে না (সম্ভবও ছিল না)|
বিশেষ এবং অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনে কোনো রাশিকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে মাপার এই পদ্ধতি আসলে গণিতের একটি শাখা ক্যালকুলাস, যা পৃথকভাবে আবিষ্কার করেছিলেন নিউটন আর লাইবনিৎজ| ক্যালকুলাসের আবার দুটি শাখা, ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস আর ইন্টেগ্রাল ক্যালকুলাস| প্রথমটিতে যেকোনো পরিবর্তনশীল রাশিকে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাগে ভেঙে ফেলা হয় আর পরেরটিতে এই ক্ষুদ্রাংশগুলিকে জুড়ে দেওয়া হয়| যে সব সমস্যায় কোনো রাশিকে কিছু সময় পরপর (অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন সময়ান্তরে) মাপলে সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে না সেই সমস্যাগুলির সমাধান বীজগাণিতিক পদ্ধতিতে করা সম্ভব নয়, আর সেখানেই ক্যালকুলাসের কেরামতি| নির্দিষ্ট সময়ান্তরকে অসংখ্য ছোটছোট ভাগে ভেঙে ফেলে কন্টিনুয়াস পদ্ধতিতে পরিমাপ নিয়ে নিখুঁত ফলাফল উপস্থাপনার মাধ্যমে কেল্লাফতে করে ক্যালকুলাস| কি ভাবছেন? আপনিও ক্যালকুলাস শিখে জটিল সমস্যার সমাধান করবেন?