নতুন গবেষণায় হিউম্যান জিনোমের সম্পূর্ণ সংকেত উদ্ধার করার প্রচেষ্টা

নতুন গবেষণায় হিউম্যান জিনোমের সম্পূর্ণ সংকেত উদ্ধার করার প্রচেষ্টা

অতীতে বেশ কয়েকবার গবেষকরা বলেছেন যে একটা সম্পূর্ণ হিউম্যান জিনোম তাঁরা ডিকোড করেছেন বা জানার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সেই খসড়াটা অসম্পূর্ণ ছিল। সম্পূর্ণ হিউম্যান জিনোম সংক্রান্ত গবেষণা সায়েন্স পত্রিকায় এবং নেচার মেথোডস নামক জার্নালে 31 মার্চ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল। সিয়াটেলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান জেনেটিসিস্ট ইভান ইচলার বলেছেন, “আমরা আজ সত্যিই এটি করে দেখিয়েছি।”
ইচলার ও এক দল গবেষক বায়োমেডিকাল গবেষণায় এক নতুন ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিএনএ-র পুনরাবৃত্তিমূলক অংশগুলোকে জানার চেষ্টা করেন। তাঁরা জিনোমের যে সংস্করণ আগে রেফারেন্স হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত সেই সংস্করণ ব্যবহার করেননি। সায়েন্স পত্রিকায় গবেষকরা বলেন যে ডিএনএ-র এই জটিল অংশগুলো নির্ধারণের মাধ্যমে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডিএনএ বেস চিহ্নিত হয়েছে যা জিনোমের প্রায় 8 শতাংশ । প্রতিটি ক্রোমোজোমে দুটি করে সিস্টার ক্রোমাটিড থাকে যা সেন্ট্রোমিয়ার দ্বারা যুক্ত । এই সেন্ট্রোমিয়ার কোশ বিভাজনের সময় ক্রোমাটিডকে ধরে রাখে। সেন্ট্রোমিয়ারের আবস্থান অনুযায়ী ক্রোমোজোমের বাহু- ছোটো ও বড়ো আকারে নির্ধারিত হয়।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির জেনেটিসিস্ট এবং টেলোমিয়র-টু-টেলোমিয়র (T2T) কনসোর্টিয়াম দলের এক সদস্য, রাজীব ম্যাককয় বলেন- যে অংশগুলো নিয়ে পূর্বে অনুসন্ধান করা হয়নি বর্তমানে সেগুলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে কারণ এই অংশগুলো অন্বেষণ করে এর মধ্যে কী আছে তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। টেলোমিয়রস হল ক্রোমোজোমের প্রান্তে অবস্থিত ডিএনের পুনরাবৃত্তিমূলক অংশ। জুতোর ফিতের প্রান্তে থাকা অ্যাগলেটগুলোর মতো, তারা ক্রোমোজমকে যে কোনো ধরনের আঘাত থেকে বা অন্য ক্রোমোজোমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
অন্যন্য গবেষকদের কাছে গবেষণার এই তথ্যগুলো অনুসন্ধানের জন্য মজুত থাকলেও, তারা তা নিয়ে গবেষণা করেননি; কিছু গবেষক এই তথ্য নিয়ে অনুসন্ধান করতে শুরু করেছেন, যেমন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন, সেন্ট লুইসের জেনেটিসিস্ট টিং ওয়াং৷ তাঁর মতে বায়োমেডিকাল সায়েন্স নিয়ে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে একটা সম্পূর্ণ জিনোম রেফারেন্স থাকা এক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সম্পদ তবে এই হিউম্যান জিনোম এখনও পুরোপুরি সম্পূর্ণ নয়।
হিউম্যান জেনেটিকস নিয়ে যারা অধ্যয়ন করছেন তাদের বোঝার জন্য কিছু মাইলফলক নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রারম্ভিকদের জন্য বলা হয়েছে , এই নতুন ডিএনএ 13, 14, 15, 21 এবং 22 ক্রোমোজোমের ছোট বাহুগুলো ধারণ করে৷ এই “অ্যাক্রোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমগুলো” গঠনগতভাবে অন্যন্য ক্রোমোজোমের X-এর আকৃতির মতো নয় বরং তাদের দুটো লম্বা বাহু ও দুটো ছোটো বাহু রয়েছে।
এই ছোট বাহুগুলোতেই rDNA জিনের অবাস্থান, যা rRNA জেনেটিক কোড সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণ করে।এই rRNA আসলে রাইবোসোমের প্রধান উপাদান। রাইবোসোম হল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা যার মধ্যে আরএনএ এবং সংশ্লিষ্ট প্রোটিন রয়েছে যা প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য কাজ করে। জেনেটিক নির্দেশাবলী অনুসারে রাইবোসোম প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রোটিন তৈরি করে। প্রতিটি ব্যক্তির জিনোমে এই rDNA অংশের শত শত অনুলিপি রয়েছে, গড়ে 315টি করে, তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি বেশি বা কমও হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মিগা বলেছেন যে প্রতিটি অ্যাক্রোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম, এবং সেই অ্যাক্রোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমের প্রতিটি rDNA-তে ভিন্নতা রয়েছে, যা প্রতিটা ক্রোমোজোমের জন্য আলাদা।
ইচলার ও তার সহকর্মীরা সায়েন্স পত্রিকায় বলেছেন যে তাঁরা ফ্লুরোসেন্ট ট্যাগ ব্যবহার করে দেখেছেন যে rDNA-এর অংশের পাশে অবস্থিত রিপিটেটিভ ডিএনএ এবং কখনও কখনও rDNA-ও অন্য ক্রোমোজোমে সংযোজিত হয় ও স্থান পরিবর্তন করে। মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছেন কেন এবং কীভাবে এই ঘটনাটা ঘটে তা এখনও অজানা।
এই নতুন পূর্ণ হিউম্যান জিনোমে 3,604টা জিন রয়েছে, যার মধ্যে 140টা জিন প্রোটিন এনকোড করে এবং এই জিনগুলো পুরনো, অসম্পূর্ণ জিনোমে উপস্থিত ছিল না। এর মধ্যে অনেক জিনই আগের পরিচিত জিনের থেকে সামান্য ভিন্ন অনুলিপি আবার কিছু জিন মস্তিষ্কের বিবর্তন এবং বিকাশ, অটিজম, রোগ প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়া, ক্যান্সার এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের সাথে জড়িত। এই সমস্ত জিন কোথায় অবস্থিত তা জানা থাকলে তারা কী কাজ করে তা আরও ভালোভাবে বোঝা যায় এবং এই জিনগুলোই মানুষকে মানুষ করে তুলতে সাহায্য করে ।
বিজ্ঞানে সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম হল মানব দেহের ক্রোমোজোমে সেন্ট্রোমিয়ারের সম্পূর্ণ গঠন আবিষ্কার। সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থান বেশিরভাগ ক্রোমোজোমকে তাদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত X আকৃতি দেয় এবং এই সেন্ট্রোমিয়ারসে কাইনেটোকোরস থাকে যা কোশ বিভাজনের সময় ডিএনএ-কে ভাগ করে। কোশের মধ্যে এই কাজটা হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে একটা যা কোনোভাবে ভুল হয়ে গেলে জন্মগত ত্রুটি, ক্যান্সার বা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। গবেষকরা ইতিমধ্যেই ফলের মাছির সেন্ট্রোমিয়ার এবং মানুষের 8 নং ক্রোমোজোমের, X এবং Y ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণা করেছেন, কিন্তু এই প্রথম গবেষকেরা মানুষের সেন্ট্রোমিয়ারের বাকি অংশের একটা আভাস পেয়েছেন৷
সায়েন্স পত্রিকায় মিগা বলেছেন, ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ারে আলফা স্যাটেলাইট নামে পরিচিত DNA-এর প্রায় 171 বেস পেয়ারের প্রথম থেকে শেষ অবধি সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি হিসেবে থাকে। কিন্তু DNA-এর এই পুনরাবৃত্তিগুলো অন্য পুনরাবৃত্তির মধ্যে সংযোজিত হয়ে পড়ে এবং একটা জটিল প্যাটার্ন তৈরি করে যা একটা ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার থেকে অন্য ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ারকে পৃথক করে।এই গঠন জানার ফলে গবেষকেরা ক্রোমোজোমের বিভাজন এবং কীভাবে এই প্রক্রিয়া কখনও কখনও বন্ধ হয়ে যায় সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবেন।