বিষে বিষক্ষয়?

বিষে বিষক্ষয়?

আঘাতজনিত স্থান থেকে রক্তক্ষরণের ফলে বিশ্বজুড়ে এক বড়ো সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে, এই রক্তপাত বন্ধ করার যথাযথ পদ্ধতি খুঁজে বের করা একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট ফর বায়োএঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ন্যানোটেকনোলোজির একদল গবেষক জানিয়েছেন রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে দারুণ কার্যকারী একটি সূত্রের সন্ধান পেয়েছেন। তারা জানিয়েছেন সেই আশ্চর্যজনক সূত্রটি হল সাপের বিষ।

গবেষক আমান্দা কিজাস বলেছেন, সাপের বিষের মধ্যে দুধরনের প্রোটিন, একটি শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে, অপরটি শরীর তার নিজস্ব রক্ত তঞ্চনের পদ্ধতিতে বাধা দেওয়ার জন্য যে পথ অবলম্বন করে, তার অন্তরায় হয়।

কিজাস আর তার সহকারীরা লক্ষ করেছেন বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার জন্য যে সমস্ত উপকরণ ব্যবহার করা হয়, তা বিশেষ কার্যকরী নয়, বেশিরভাগ সময়ে রোগী হাসপাতালে পৌঁছোনোর আগেই তার মৃত্যু হয়।

নানা ধরনের পদ্ধতির ওপর গবেষণা চলছে, যেমন রক্ত থেকেই উপকরণ নিয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করা, কিন্তু তা এখনও প্রায়োগিক দিক থেকে সফল হয় নি। এক্ষেত্রে কিজাস ও তার সহকারীদের মতে হাসপাতালে পৌঁছোনোর আগেই সাপের বিষ থেকে পাওয়া এই প্রোটিন রোগীর শরীরে ব্যবহার করা যাবে। যেহেতু অস্ট্রেলিয়াতে বহু  বিষাক্ত  সাপ পাওয়া যায়, তাই এই উপকরণটিও সহজলভ্য হবে।

এই গবেষকরা অ্যাডভান্সড হেলথকেয়ার মেটিরিয়ালস – এ সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, যেখানে তারা বলেছেন সাপের বিষের প্রোটিন ফর্মুলাটি হাইড্রোজেল আকারে ব্যবহার করা সম্ভব, এই হাইড্রোজেল তাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিজাস বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন, যে  বর্তমানে ব্যবহৃত অ্যান্টিফাইব্রিনোলাইটিক্স (এমন ওষুধ, যা রক্ত তঞ্চন রোধ করাকে বাধা দেয়) শিরায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হয়, ফলে চিকিৎসা ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত ব্যক্তিই একমাত্র এটি প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু তাদের আবিষ্কৃত ওষুধের সুবিধা হল, এটি শরীরের ক্ষতস্থানে সরাসরি ব্যবহার করা যায় উপরন্তু বর্তমানে ব্যবহৃত ট্রানেক্সামিক অ্যাসিডের থেকে এটি বেশি কার্যকরী। শরীরের বাইরে সরাসরি ব্যবহার হওয়ার ফলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গবেষকরা সাপের বিষ থেকে দুটি প্রোটিন নিয়ে কাজ করেছেন, প্রথমটি – একারিন, যা খুব তাড়াতাড়ি রক্ত তঞ্চন হতে সাহায্য করে, দ্বিতীয়টি – টেক্সটিলিনিন – শরীরের স্বাভাবিক পদ্ধতি যা জমাট হওয়া রক্তকে ভাঙে, তাকে বাধা দেয়।

যখন সাপের কামড়ের ফলে শরীরে এই প্রোটিনগুলি ঢোকে তখন পারস্পরিক ক্রিয়ায় তা প্রাণঘাতী হয়, কিন্তু তাপ দ্বারা প্রভাবিত জেলের মাধ্যমে যখন এটি প্রয়োগ করা হয়, তখন তা জীবনদায়ী হিসাবে কাজ করে। ইন ভিট্রো ও ইন ভিভো মাধ্যমে দেখা গেছে এর প্রয়োগে ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে রক্ত তঞ্চন শুরু হয়ে যায়, যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় রক্ত তঞ্চনের তুলনায় আট গুণ দ্রুত হারে ঘটে।

কিজাস আরো জানান, যে সমস্ত রোগীদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে রক্ত তঞ্চন হয় না, প্রভূত রক্তক্ষরণের সময় এই ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা তাদের ক্ষেত্রেও কার্যকরী হতে পারে। রক্তকে লঘু রাখার জন্য অনেক সময় ওয়ারফেরিন ব্যবহার করা হয়, তা রক্তকে জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, যার ফলে শরীর স্বাভাবিকভাবে রক্ত তঞ্চন করতে পারে না, কিন্তু  সেক্ষেত্রেও  সাপের বিষ থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন রক্ত তঞ্চনের কাজ করে। তিনি বলেন, হিমোফিলিয়া, ভন উইলব্র্যান্ড রোগের শিকার যারা; যাদের রক্ত তঞ্চনের জন্য জেনেটিক মিউটাশনের আশ্রয় নিতে হয়, তাদের ক্ষেত্রেও এই ওষুধটি রক্ত তঞ্চনের কাজ করবে।

ওষুধটি হাইড্রোজেল আকারে ব্যবহার করাও বেশ সুবিধাজনক। ঠাণ্ডায় হাইড্রোজেলের প্রোটিনগুলি তরল অবস্থায় থাকে, কিন্তু ক্ষত স্থানের সংস্পর্শে এলে, গরমে এটি জেল অবস্থায় পরিণত হয়। এর দুধরনের সুবিধা বিদ্যমান – তরল অবস্থায়  হাইড্রোজেল বিভিন্ন আকারের ক্ষতস্থানকে ঢাকতে পারে; আবার যখন এটি জেল অবস্থায় পরিণত হয় এর প্রলেপ ক্ষতকে বাইরের রোগ জীবানু থেকে বাঁচায় এবং প্রোটিনকে যথাযথ কাজ করতে সাহায্য করে।

হাইড্রোজেল দিয়ে প্রলেপ দেওয়া রোগীর ক্ষতস্থান, গজ দিয়ে ঢেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব ও রোগীকে  নিরাপদভাবে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। এটি ভবিষ্যতে প্রচুর ব্যবহৃত হবে, তা নিয়ে গবেষকরা যথেষ্ট আশাবাদী।

কিজাস আশা প্রকাশ করেন, লোকের গাড়িতে ফার্স্ট এড বক্সে এই উপকরণটি থাকবে, যা আঘাত লাগার সময় থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অবধি মানুষকে সুরক্ষা দেবে। এই উপকরণটির বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার কথা  তিনি ভাবছেন।

তিনি আরো বলেন, প্রকৃতি নিজে এই পদ্ধতি তৈরি করে রেখেছে, যা তারা ব্যবহার করে মানুষের অনিন্ত্রিত রক্তপাত বন্ধ করে, তাদের জীবন বাঁচানোর কাজে লাগাতে চাইছেন। এই পদ্ধতিতে রক্তক্ষরণ পাঁচ গুণ কমে যাবে আর স্বাভাবিক শারীরিক পদ্ধতিতে রক্ত জমাট বাঁধতে যা সময় লাগে, তার তিন গুণ দ্রুত হারে রক্ত জমাট বাঁধবে।