মস্তিষ্কে ক্ষুদ্র যন্ত্রের অনুপ্রবেশ, দেবলীনার আবিষ্কারের গল্প

মস্তিষ্কে ক্ষুদ্র যন্ত্রের অনুপ্রবেশ, দেবলীনার আবিষ্কারের গল্প

দেবলীনা সরকার ছোটো ছোটো যন্ত্র বানালেও তার স্বপ্ন অনেক বড়ো। তার স্বপ্ন এত বড়ো যে সেগুলো একদিন আমাদের মনকে বাঁচাতে পারবে। দেবলীনা, এমআইটির একজন ন্যানোটেকনোলজিস্ট এবং সহকারী অধ্যাপক। একাধারে তিনি একজন নৃত্যশিল্পী অন্যদিকে তিনি মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পরেন তার স্নাতকস্তরের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে হাইকিং-এর উদ্দেশ্যে কখনো তার গণতব্যস্থল হতে পারে ইয়েলোস্টোন ন্যাশেনাল পার্ক। তার কাছে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যেমন প্রয়োজনীয় তেমনি জরুরি হল তার গবেষণা, যার জন্য তিনি দিনরাত অতিবাহিত করেন। তিনি যে যন্ত্রগুলো তৈরি করেন তা এতই ছোটো যে সেগুলো শরীরের কোশে বসিয়ে দেওয়া যাবে। তবে তিনি অনেক বড়ো স্বপ্ন দেখেন। তিনি আশা রাখেন, যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক যন্ত্র তিনি তৈরি করেন, যা এক বিন্দু ধূলিকণার চেয়েও ছোটো, সেগুলো একদিন তিনি মানব দেহের মস্তিষ্কে স্থাপন করতে পারবেন।
বর্তমানে, আল্জাইমার, পারকিনসন এবং অন্যান্য স্নায়বিক রোগ বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের মন মস্তিষ্কে আঘাত হেনেছে। এই রোগগুলো সনাক্ত করা এবং এর থেকে রেহাই পেতে এই ক্ষুদ্র মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বায়োইঞ্জিনিয়ারিং গবেষক এবং পাশাপাশি দেবলীনার সহযোগী সমীর মিত্রগোত্রী বলেছেন যে দেবলীনা বরাবরই মানবদেহের বিভিন্ন তন্ত্রে ইলেকট্রনিক্স প্রয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন। দুটি ভিন্ন ভিন্ন জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন করতে চেয়েছেন দেবলীনা।
কাজ করতে করতে মস্তিষ্কের প্রতি দেবলীনার আগ্রহ জন্মায়, কারণ সর্বনিম্ন শক্তির সাহয্যে চলে মানব দেহের মস্তিষ্ক। এমআইটি-তে পোস্টডক হিসাবে অ্যামাইলয়েড-বিটা প্লেকের ইমেজিং-এর উপর একটি প্রকল্প তার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে এবং তিনি ন্যানো-সাইবারনেটিক বায়োট্রেক দলে যোগদান করেন। তার দল যেমন ন্যানো ডিভাইস তৈরি করে, যা জীবন্ত কোশের সাথে যোগসূত্র তৈরি করতে পারে, তেমনি “নিউরোমরফিক” কম্পিউটিং ডিভাইস তৈরি করে, যার সাথে মানুষের মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের গঠনগত মিল র‍য়েছে।
এখনও অবধি, দলের সবচেয়ে উদ্ভাবনী যন্ত্র বা ডিভাইস হল সেল রোভার, একটি সরু অ্যান্টেনা যা কোশের ভিতরে প্রক্রিয়াগুলো নিরীক্ষণ করতে পারে। ২০২২ সালে একটি গবেষণায় সরকার এবং তার সহকর্মীরা একটি পরিণত ব্যাঙের ডিমের কোশে একটা অণুজীবের (টার্ডিগ্রেড) আকারেরে সেল রোভার, চৌম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে বব্যবহার করেছিলেন।তারা দেখিয়েছিলেন যখন ন্যানো ডিভাইসটা একটা বিকল্প প্রবাহ দ্বারা সৃষ্ট চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা উদ্দীপিত হয়, তখন ন্যানো ডিভাইসের অণুগুলো জীবন্ত কোশের জন্য নিরাপদ কম্পাঙ্কতে কম্পিত হয়। একটা তারের রিসিভার ব্যবহার করে, গবেষকরা দেখেন কীভাবে সেই কম্পন ডিভাইসের নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে, আর বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। সেল রোভার একধরনের ঝিল্লির সাথে যুক্ত হয় যা বাছাই করা প্রোটিন বা অন্যান্য জৈব অণুগুলো উপর আটকে থাকে এবং সনাক্ত করে।
দেবলীনা মনে করেন, আলজাইমার রোগের প্রাথমিক লক্ষ্‌ যেমন মস্তিষ্কে প্রোটিনের গঠনগত পরিবর্তন সনাক্ত করতে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা যেতে পারে। আজ, যখন একজন ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায় তখন তিনি জানতে পারেন যে তিনি আলজাইমার রোগে আক্রান্ত কিন্তু ততদিনে তার যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা আর কখনও ঠিক করা যাবে না। সেল রোভারকে ন্যানো ডিভাইসের সাথেও যুক্ত করা যেতে পারে যা কোশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে এবং সেটিকে বৈদ্যুতিকভাবে উদ্দীপিত করে। এর ফলে নতুন ধরনের মস্তিষ্কের বিদ্যুদ্বাহক বা ইলেক্ট্রোড এবং সাবসেলুলার পেসমেকারের তৈরি হতে পারে। আবার অস্ত্রোপচারের বদলে এই যন্ত্রের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা যেতে পারে যেমন মস্তিষ্কে বেড়ে ওঠা একটা ছোটো টিউমার সনাক্ত করা, এমনকি সেটাকে নির্মূল করাও।