মহাকাশের আবহাওয়ায় গোলযোগের দায় সভ্যতারও  

মহাকাশের আবহাওয়ায় গোলযোগের দায় সভ্যতারও  

আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে জটিল স্পেস সিস্টেম। সভ্যতাপ্রসূত ঠাণ্ডা যুদ্ধের অন্ধকার কৃত্রিম আভায় দেখে নেওয়া যাক, সেই মহাজাগতিক আস্তরণকে কতটা সুরক্ষিত রাখতে পেরেছি আমরা । স্পেসের আবহাওয়ার পরিবর্তন বলতে, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের অনভিপ্রেত আচরণ হতে পারে । চৌম্বকমণ্ডলীর স্বাভাবিক পরিবর্তন সূর্যের মতো নক্ষত্রের চৌম্বক প্রভাবে হতে পারে। কিন্তু নতুন তথ্য জানাচ্ছে, পরমাণু বিস্ফোরণের মতো পরীক্ষামূলক ঘটনাও পৃথিবীর চৌম্বকবেষ্টনীতে তৈরি করতে পারে ক্ষতিকারক অস্থিতি। কৃত্রিম উপগ্রহ বা মহাকাশচারীদের এই মারণ বিকিরণের থেকে বাঁচাতে নাসা’র উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই তথ্য।

১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘স্টারফিশ’ ‘আরগাস’ ‘টিক’ নাম দিয়ে বিভিন্ন দূরপাল্লার পরমাণু পরীক্ষা চালিয়েছে। যদিও যুদ্ধবিরতি সেগুলি থামিয়েছে কিন্তু এখনও সেই উৎক্ষেপণগুলির পরোক্ষ প্রভাব রয়ে গেছে মহাকাশে। ‘স্পেস সায়েন্স রিভিউস’-এ প্রকাশিত নতুন গবেষণাপত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মনুষ্যকৃত এই ক্ষতিগুলির উপরেই।

ম্যাসাচুয়েটসের হেসট্যাক অবসারভেটরি’র সহকারী প্রধান ফিল এরিকসন জানাচ্ছেন, যদিও প্রধানত সূর্যের খামখেয়ালীর জন্যই স্পেসের অবহাওয়ার পরিবর্তন হয়, তবে মানুষের অপকর্মের দোষেও পৃথিবীর নিকটস্থ মহাকাশের ক্ষতিও হয়ে থাকে।

কৃত্রিম উপগ্রহ এবং মহাকাশচারী বিজ্ঞানীরা যে জায়গায় থাকেন, সেখানে সাধারণত বহির্জাগতিক কারণেই চরম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সূর্য থেকে আগত উচ্চশক্তির কণিকা, সৌরঝড় – ইত্যাদি পৃথিবীর চৌম্বককবচে অত্যন্ত দ্রুত বেগে আঘাত করে । অধিকাংশ চার্জড কণিকা প্রত্যানয়ক পথে ফিরে যায়; কিন্তু অবশিষ্ট কিছু কণা পৃথিবীর পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে – স্যাটেলাইটের বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা বিগড়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবধি তারা করতে পারে। এই সৃষ্টিছাড়া কণাগুলির মধ্যে বহমান যে তড়িৎচুম্বকীয় শক্তি- তাই’ই অরোরা দেখায় আমাদের । পাওয়ার গ্রিড ধ্বংস করার ক্ষমতাও সেই শক্তির আছে।

ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময়ে, মাটি থেকে ১৬-২৫০ মাইল উচ্চতা অবধি বিস্ফোরণের পরীক্ষা করা হয়েছিল – যদিও ফলস্বরুপ অন্য এক বিফল মেরুজ্যোতি ভয়ার্ত করেছিল বিশ্ববাসীকে। ভূচৌম্বকীয় ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটেছিল – চৌম্বকরেখাগুলি ওলটপালট হয়েছিল এবং মাটিতে নতুন করে আবেশিত হয়েছিল বিদ্যুতক্ষেত্র ।

ঐ সময়েই কিছু পরীক্ষার ফলে কৃত্রিম বিকিরণ বলয়ও তৈরি হয়েছে বলে দাবী গবেষকদের।  প্রাকৃতিক ভ্যান হ্যালেন বিকিরণ বলয়, যা কিনা কিছু চার্জড কণাকে একসাথে ধরে রেখেছে একটি স্তরে, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র। কৃত্রিম বলয়টি থেকে নির্গত চার্জড কণাগুলি ভ্যান হ্যালেন বলয়ের কাছে এবং ভিতরে প্রায় এক সপ্তাহ থেকে একটি ক্ষেত্রে এক বছর যাবত ঘোরাফেরা করেছে। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত কৃত্রিম উপগ্রহগুলির ভেতর বৈদ্যুতিন গোলযোগ তৈরি করতে পারে এই কণিকাগুলো।

সভ্যতা ধ্বংসের শিখরে গিয়ে তবুও নকলই মাত্র করতে পারল প্রকৃতিকে ক্ষণিকের জন্য হলেও । ১৯৫৮ সালের পয়লা অগস্ট প্রশান্ত মহাসগরের বুকে জন্সটন দ্বীপে পরীক্ষামূলক টিক’ উৎক্ষেপণে এরকমই এক কৃত্রিম মেরুজ্যোতি তৈরি হয়েছিল। পশ্চিম সাময়ায় ঐ একই দিনে অস্বাভাবিক অরোরা দেখা যায় আপিয়া অবসারভেটরি থেকে। পলনেশিয়ান দ্বীপরাষ্ট্রের উপর দিয়ে বিন্যস্ত চৌম্বকরেখা বরাবর চালিত হয় ঐ পরীক্ষা থেকে তৈরি হওয়া চারজড কণাগুলি ।

ঐ একই বছরের শেষে যখন আরগাস এর পরীক্ষা হয়, তখন সুইডেন থেকে অ্যারিজোনা পর্যন্ত ভূচৌম্বকীয় ঝড় দেখতে পাওয়া যায়। এই পরীক্ষাটি অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় করা হয়েছিল, যাতে কণাগুলি পৃথিবীর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করতে সক্ষম হয়। দুটো উচ্চবেগসম্পন্ন তরঙ্গের বেগ মাপা সম্ভব হয়েছিল – একটা প্রতি সেকেন্ডে ১৮৬০ মাইল আর অন্যটা প্রায় ৪৬৫ মাইল প্রতি সেকেন্ড। যদিও এই প্রভাব খুব কম, কয়েক সেকেন্ডের জন্যই দেখা গিয়েছিল।

বহুদিন আগে থেকেই পরিমণ্ডলে এইধরণের পরীক্ষা করায় নিষেধাজ্ঞা আছে। যদিও, ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়গুলি থেকে শিক্ষা নিয়েই হয়তো বিজ্ঞানীরা বুঝবেন, কীভাবে পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা পরিকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত বিষয়গুলি স্পেস আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল।

তথ্যসূত্রঃ নাসা/গোডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার