‘হাবল ফোকাস’ : পরম বিষ্ময়ের আকাশ

‘হাবল ফোকাস’ : পরম বিষ্ময়ের আকাশ

এক ২০২১ এর ডিসেম্বরে উৎক্ষেপিত ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’কে বাদ দিলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে জেমস -এর পূর্বসূরি ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপে’র জুড়ি মেলা ভার। যদিও জেমস ওয়েবে’র কাজ এখনো সে অর্থে শুরু হয়নি। আমরা এক্ষেত্রে ‘জেমস ওয়েবে’র ভাবি কর্মদক্ষতাকেই ইঙ্গিত করতে চাইছি। নচেৎ কৃত কর্মের হিসেব ধরলে ‘হাবল’ই আপাতত অদ্বিতীয়। ১৯৯০ -এ উৎক্ষেপনের পর থেকে গত তিন দশকেরও বেশি সময়ে ‘হাবল’ জ্যোতির্বিজ্ঞানে একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার যোগ করে গেছে। সমাধান করেছে মৌলিক মহাজাগতিক প্রশ্নগুলির। যেমন আজ আমরা কত অনায়াসেই জানি প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে রয়েছে একটি করে মহাদানব ব্ল্যাকহোল; ইউনিভার্সের গ্যালাক্সিগুলি যে ছোটো কাঠামো থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের রূপে পৌঁছেছে, রঙিন নেবুলার বিচ্ছুরনের মধ্যে থেকে জন্ম নেয় নক্ষত্রেরা – এসব হাবলেরই আবিষ্কার। আমাদের ইউনিভার্স যে ক্রমেই ইলাস্ট্রেট হচ্ছে (রবার টানলে যেমন বেড়ে যায়) সেকথাও নিশ্চিত করেছে ‘হাবল’। এরকম কত আবিষ্কার আমাদের জ্ঞানের সীমানা বাড়িয়ে চলেছে গত তিন দশক জুড়ে। প্রসারিত করে চলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিধি। ইউনিভার্সের কোনো কিছুই যে ঠিক অতিলৌকিক নয়, সবেরই নিখুঁত কার্যকারন সূত্র আছে- ইউনিভার্সকে সেই বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিতে জানতে সাহায্য করে চলেছে ‘হাবল’ অনবরত।
আজ আমাদের কল্পনায়, গল্পে-সাহিত্যে, সিনেমায় ‘এলিয়েন’ খুবই পরিচিত শব্দ। পৃথিবীর বাইরেও কোনো গ্রহে প্রাণের সন্ধান যে থাকতে পারে সে কল্পনা ‘হাবল’ উৎক্ষেপনের আগেও ছিল। হাবল ঝুঁকেছে তার বস্তুনিষ্ঠ দিকটাতে। সহজেই অনুমেয় বাইরের গ্রহে প্রাণ খোঁজার জন্যে গ্রহটাকে প্রথম ডিটেক্ট করতে হয়। ‘হাবল’ যখন উৎক্ষেপন করা হয় তখনো কোনো এক্সোপ্ল্যানেট ডিটেক্ট হয় নি। প্রসঙ্গত সৌরমণ্ডলের বাইরে যেকোনো নক্ষত্রকে আবর্তন করে এমন গ্রহদের এক্সোপ্ল্যানেট বলা হয়। ১৯৯২ সালে প্রথম কনফার্ম এক্সোপ্লানেট ডিটেক্ট করা সম্ভব হয়। নাসার অতি সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে ডিটেক্ট করা এক্সোপ্ল্যানেটের সংখ্যা আজ ৫০০০ এরও বেশি। সেসবের অনেক গ্রহেই প্রাণের সম্ভাবনার জন্যে গ্রহের বায়ুমন্ডল, উপাদান ইত্যাদি পরখ করে দেখার কাজ করে চলেছে ‘হাবল’। কেবল প্রাণের সম্ভাবনা ব্যাতিরেকেও ডিটেক্ট করা গ্রহের বায়ুমন্ডল বা গ্রহজ উপাদান নিরীক্ষনের প্রচেষ্টাও চালায় ‘হাবল’। তেমনই একটি গ্রহ ট্রাপ্পিসিট-ওয়ান এফ(TRAPPIST-1F)। যার আকৃতি পৃথিবীরই মতো। পৃথিবী থেকে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে এই গ্রহ। ‘নাসা-হাবল’ নামের ইন্সটাগ্রাম পেজ থেকে সম্প্রতি এই গ্রহেরই একটি ইলাস্ট্রেট ছবি শেয়ার করা হয়েছে। এবং সেই সাথে তিরিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে হাবলের কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত একটি বইয়ের কথা বলা হয়েছে ইন্সটাগ্রামের ঐ পোস্টে। সে বইয়ের নাম – “হাবল ফোকাস- স্ট্রেঞ্জ নিউ ওয়ার্ল্ডস”। সৌরজগতের বাইরের বিভিন্ন গ্রহ, সেসব গ্রহের খুঁটিনাটি নিয়ে এই বই- যা আমাদের নিয়ে যেতে পারে অপার বিষ্ময়ের দুনিয়ায়।৫২ পাতার এই ছোট্ট বইটি নাসা দিচ্ছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। পিডিএফ ফর্মাটে বা ই-বুক ফর্মাটে নাসার সাইট থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারেন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের আগ্রহী পাঠক।

জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন ‘আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে’। চলতি প্রয়োগে আকাশ শব্দটার বিস্তৃতি কতটা টের পাই আমরা? নব্বই এর দশকের কিশোর কিশোরী যেমন আনমনে গুন গুন করতে থাকেন, অঞ্জন দত্ত- ‘আমার জানলা দিয়ে একটুকরো আকাশ দেখা যায়’। আমাদের খালি চোখের চলতি আকাশ দেখা আক্ষরিক অর্থেই ‘টুকরো আকাশ’। পাড়া, গ্রাম, শহর, জেলা, রাজ্য, দেশ এসব ছাড়িয়ে পৃথিবী ; আর পৃথিবী ছাড়িয়ে সৌরজগত, আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ – এমন কত কত ছায়াপথের সম্মিলনে এই ইউনিভার্স। কেবল আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিতেই কত নক্ষত্র,গ্রহ আছে তা’ই আমরা জেনে উঠতে পারিনি। তবু ‘হাবল’ গত তিন দশকের নিরলস প্রচেষ্টায় দশ লক্ষের বেশি ‘অবজারভেশন’ প্রকাশ করেছে। কত কত গ্যালাক্সি কে, আকাশের রঙিন দুনিয়াকে চিনিয়েছে আমাদের। হাবলের দৌলতে আমরা সত্যি সত্যিই টের পেয়েছি আকাশের বিস্তৃতি। বুঝেছি আকাশ কীভাবে ‘আকাশে আকাশে’ ছড়িয়ে থাকতে পারে। ‘হাবল স্পেস টেলিস্কোপে’র ফোকাসই সুলুক সন্ধান দিয়েছে বিষ্মিত দুনিয়ার- আকাশের- মহাকাশের।