এক, দুই, তিন, চার…
এই প্রবন্ধটির পাঠক, আপনি অন্তর্জালে চোখ রেখে যখন এটি পড়ছেন, তখনই হয়তো অনেক দূরে মহাশূন্যে কোথাও কোনও নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটছে, আবার ধূলিকণা গ্যাসবাষ্পের মিশেল থেকে জন্ম নিচ্ছে কোনও নয়া জ্যোতিষ্ক। কোনও বিমান শতাধিক যাত্রী নিয়ে উড়ে চলেছে তার গন্তব্যে, আবার কোনও বিজ্ঞানী নিভৃত গবেষণাগারে নিবিষ্ট অনুসন্ধানে উন্মোচন করছেন প্রকৃতির কোনও অচিন রহস্য। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি এই বিপুল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিনিয়ত যা কিছু ঘটে চলেছে তা আসলে মাত্র চার রকম বলের কীর্তি! অবাক হওয়ার মতই কথা বটে! এই চারটি বল কী কী? গ্রহ, তারা, উপগ্রহ, মহাকাশের যাবতীয় বড়সড় রথী মহারথীরা চালিত হয় মহাকর্ষ বলের দ্বারা। এই যে আমাদের ঘরে আলো-পাখা চলে, আরও কতশত যন্ত্রপাতির উপর আমরা হরদম নির্ভর করি, সেইসবই চলছে তড়িৎচুম্বকীয় বলের প্রভাবে। আবার এই যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণু আর তাদের তস্য ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস, সেখানে নিস্তড়িৎ নিউট্রনদের সঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ ধনাত্মক আধানের প্রোটন কণা কী অনায়াসে গাদাগাদি করে বসে থাকে, সম আধানযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বিকর্ষিত হয়ে দূরে ছিটকে যায় না, বরং তীব্র আকর্ষণে পরস্পর ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকে, সে হল নিউক্লিয় দৃঢ় বলের অবদান। আর ভয়ানক পরমাণু বিস্ফোরণ হোক কিংবা পারমাণবিক চুল্লীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, তেজস্ক্রিয়তা যেখানে, সেখানেই হাজির মৃদু বল।
চিত্র ১: বিভিন্ন প্রকার বল
লেজ যার, শরীর তার
কিন্তু কেন মাত্র চার রকম বল? কমবেশি হল না কেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এমন নয় তো যে এরা আসলে একটাই অনন্য বলের চারটে ভিন্ন প্রতিরূপ? হলে সেটা কী? বিজ্ঞানের একটা প্রধান লক্ষ্যই হল জটিল জিনিসকে সহজ করে তোলা। বা বহু থেকে একে রূপান্তর। এর অজস্র নজির রয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এই যে গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়া আর সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ করা, দুটোই যে আসলে মহাকর্ষ বলের দরুণ, স্যার আইজাক নিউটন সে আবিষ্কার করে দিয়ে গেছেন। তড়িৎ আর চুম্বক যে আসলে একই বলের দুটো ভিন্নতর প্রকাশ, যার নাম তড়িৎচুম্বকীয় বল, মহান বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডের সুবাদে সে কথাও আমরা এখন জানি। আইনস্টাইন এইসব দেখেই উদ্যোগী হয়েছিলেন বহুর মধ্যে এক-কে খুঁজতে। তখন বিশ্বে দুটি প্রধান বল চর্চার কেন্দ্রে ছিল, মহাকর্ষ বল এবং তড়িৎচুম্বকীয় বল। তিনি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বে মহাকর্ষ বল সম্পর্কে ভাবনার এক নতুন দিগন্ত খুলে দেন। নিউটনের তত্ত্বে কিন্তু বলা হয়নি ঠিক কীভাবে এই বল কাজ করে। অর্থাৎ কোটি কোটি মাইল দূরে থাকা সূর্য এতটা শূন্যস্থান পেরিয়ে কীভাবে পৃথিবীকে অদৃশ্য সুতোর বন্ধনে বেঁধে রেখেছে? আইনস্টাইন এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, যে মাধ্যম মহাকর্ষকে শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে পরিবাহিত করে তা আর কেউ নয়, স্থান নিজেই! এমনিতে স্থান-সময়ের জ্যামিতিক ব্যপারটা বেশ টানটান একটা চাদরের মত, কিন্তু যেই সেখানে কোনও ভারী বস্তু যেমন সূর্য বা অন্য গ্রহ তারা ইত্যাদি চলে আসবে, তখনই স্থান-সময়ের চাদরে ভাঁজ পড়বে, আর সেই ভাঁজের আওতায় থাকা অন্যান্য ক্ষুদ্রতর মহাজাগতিক বস্তু আটকে পড়ে ঘুরপাক খাবে। এমনকি আলোও তার ব্যতিক্রম নয়। ১৯১৯-এ বিজ্ঞানীরা এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই এ তত্ত্ব সাড়া ফেলে দেয় গোটা বিশ্বে। তারপর এল আরেকটা প্রশ্ন। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে যেমন বহন করে নিয়ে যায় ফোটন কণা, মহাকর্ষকে সেভাবে বয়ে নিয়ে যাবে কে? গ্র্যাভিটন নামের একটি কণার অবতারণা করা হল এক্ষেত্রে। কিন্তু মুশকিল হল যেই তাকে প্রচলিত বিজ্ঞানের অন্য ধারার সঙ্গে জুড়তে চেষ্টা করা হল, বারবার দেখা দিল ব্যর্থতা। তবু আইনস্টাইন মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন প্রকৃতিতে এক যাত্রায় পৃথক ফল অসম্ভব। এই বিষয়ে তাঁর একটা উক্তি স্মরণীয় – ‘প্রকৃতি আমাদের শুধু সিংহের লেজটুকু দেখায়। কিন্তু আমরা তার পুরোটা একসঙ্গে দেখতে না পেলেও লেজটা যে তারই এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।’
চিত্র ২ এ: সূর্যের চারপাশে গঠিত স্থান-সময় বক্রতায় আটক পৃথিবী;
চিত্র- ২ বি : মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন;
যদিও এই বিশ্বাসে ভর করে দীর্ঘদিন (জীবনের অন্তিম তিরিশ বছর) যাবৎ ছুটে বেড়িয়েও সে সিংহের দেখা পাননি মহান বিজ্ঞানী, বরং তাঁর সময়ে থাকা দুটি বল বেড়ে হয়েছিল চারটি! নিউক্লীয় দৃঢ় বল এবং আণবিক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মৃদু বল জটিলতর করে তুলেছিল এই অনুসন্ধান। তবে বিজ্ঞানীরা এতে নিরস্ত বা হতোদ্যম হয়ে পড়েননি মোটেও। বরং আবদুস সালাম, স্টিভেন ওয়েনবার্গ এবং সেলডন গ্লাশোর মত বিজ্ঞানীরা গত শতকের সাতের দশকে পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করে দেন মৃদু বল (উইক ফোর্স ) আর তড়িৎচুম্বকীয় বল ( ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ফোর্স ) আসলে একই বলের দুটি ভিন্ন রূপ। এদের একত্র করে নাম রাখা হল ইলেক্ট্রোউইক ফোর্স। তাঁরা এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সবাইকে মিলিয়ে দেওয়া যাবে কীভাবে? সম্প্রতি প্রয়াত স্টিফেন হকিং-এর মত খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা সেই অনাবিষ্কৃত তত্ত্বের একটা নাম দিলেন, ‘থিয়োরি অফ এভরিথিং’!
চিত্র ৩: স্টিফেন হকিং
চিত্র ৪: শেল্ডন গ্লাশো, আব্দুস সালাম, স্টিভেন ওয়েনবার্গ
সুতোয় বাঁধা গল্পগাথা
‘থিয়োরি অফ এভরিথিং’-এর আসল লক্ষ্যটা হল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের (জেনারেল রিলেটিভিটি, যাকে মহাকর্ষের সাধারণ তত্ত্বও বলা হয়) সঙ্গে কণা বলবিদ্যার ( কোয়ান্টাম মেকানিক্স) মিলন ঘটানো। কিন্তু এই দুজন যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। একজন বিরাট মহাজাগতিক ক্ষেত্রের ভাগ্যনিয়ন্তা তো আরেকজন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার জগতের অধিপতি। তাই আপাতভাবে এ এক দুঃসাধ্য কাজ। আর ঠিক সেই জায়গাতেই মাঠে নেমে পড়েছে আমাদের স্ট্রিং থিয়োরি! একে তাই ‘মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব’ বলা চলে। বেশ কিছু চমকপ্রদ ধারণায় ভর করে অঙ্কের সহায়তায় এই মিল খোঁজার খেলা শুরু করল সে। সেগুলো কীরকম? স্ট্রিং থিয়োরি নামটাই সেরকম একটা ধারণার ফসল, যেখানে বলা হচ্ছে পদার্থের ক্ষুদ্রতম উপাদান কোনও কণা নয়, বরং স্ট্রিং বা সুতোর মত কিছু অংশ! সুতো একমাত্রিক বস্তু, অর্থাৎ শুধু দৈর্ঘ্যই আছে, তাদের না আছে প্রস্থ, না আছে বেধ! তা সেই সুতোটার মাপ কেমন?
একের পিঠে ৩৩টা শূন্য বসালে যত হয়, এক সেন্টিমিটারের ঠিক তত (১০-৩৩) ভাগ! ঠিকঠাক আন্দাজ পাওয়া গেল কি ক্ষুদ্রতার? একটু বিস্তারে বলি। পদার্থের ক্ষুদ্রতম অবিচ্ছিন্ন অংশকে আমরা বলি পরমাণু। তার ব্যাস অ্যাংস্ট্রম (১০-৮ সেমি) এককে মাপা সম্ভব। আবার একটি পরমাণুর অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রোটন ও নিউট্রন সম্বলিত কেন্দ্রক গোটা পরমাণুর এক লক্ষ ভাগেরও এক ভাগ জায়গা জুড়ে থাকে, কেন্দ্রকের ব্যাস পরিমাপে সাহায্য নেওয়া হয় ফার্মি (১০-১৩ সেমি) এককের। এত ছোট জিনিস আমরা খালি চোখে তো নয়ই, এমনকি অণুবীক্ষণের মাধ্যমেও দেখতে পারি না। কারণ দেখার জন্য সবার আগে চাই কোনও কিছুর উপর আলো পড়া এবং সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে সেই আলো আমাদের চোখে এসে লাগা। মজার কথা, দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যই হল মাইক্রন মাপের (১০-৪ সেমি ), যা বহুগুণ ছোট পরমাণুর মাঝের বিস্তর ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে যায়, সামান্য ধাক্কা লাগারই প্রশ্ন নেই, প্রতিফলন তো দুরস্থান! তাই আমাদের পরোক্ষ ব্যবস্থার দ্বারস্থ হতে হয়। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের অদৃশ্য আলোকতরঙ্গ, যেমন এক্স রশ্মির সাহায্যে পরমাণুর ছবি তোলা হয়। কিন্তু আরও ছোট জিনিসের জন্য আরও ছোট আকারের তরঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুশকিল অন্যত্র। তরঙ্গ যত ছোট হবে, তার শক্তি তত বাড়বে। আর সেই শক্তিশালী তরঙ্গের ঠেলায় অভীষ্ট লক্ষ্যবস্তুর স্থানচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যার ফলে তাদের সঠিক পরিমাপ পাওয়া কষ্টসাধ্য। হাইজেনবার্গের বিখ্যাত অনিশ্চয়তার সূত্র এক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য। আর এই সব কিছুর চেয়েও কোটি কোটি গুণ সরু সুতোর মত আমাদের তত্ত্বের এই স্ট্রিং। তাই এ তত্ত্বকে ভালোভাবে জানতে গণিতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আপাতত প্রত্যক্ষ কোনও উপায় নেই।
চিত্র ৫: বিভিন্ন মাপের তরঙ্গদৈর্ঘ্য, কম্পাঙ্ক এবং সংশ্লিষ্ট বস্তুর পরিচিতি
চিত্র ৬: অণু-পরমাণু, মৌলিক উপাদান কণাসমূহ এবং স্ট্রিং-এর মাপের তুলনা
সত্য কী আর মিথ্যা কী!
একটা সামান্য সুতোই যদি সবকিছুর মূলে থাকে, তাহলে বাকি এতসব মৌলিক কণা, ইলেকট্রন, প্রোটন, কোয়ার্ক, লেপ্টন – যাদের পদার্থের উপাদানরূপে দেখা যায়, তারা আসলে কী? স্ট্রিং থিয়োরি অনুসারে তারা সবাই ঐ সুতোর বিভিন্ন মাত্রার কম্পনের ফসল। বেহালার তার বিভিন্ন কম্পাঙ্কে কেঁপে গিয়ে যেমন নানারকম সুর সৃষ্টি করে, অনেকটা সেভাবেই নাকি এই স্ট্রিংগুলো আলাদা আলাদা ভাবে কেঁপে উঠে তৈরি করে উপাদান মৌলিক কণাসমূহ। ছয়ের দশকে প্রথম তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে থেকে এমন একটা ধারণার কথা উঠে আসে, যদিও অচিরেই তা যথেষ্ট দৃঢ় ভিত্তির অভাবে চাপা পড়ে যায়। নয়ের দশকে এসে এই তত্ত্ব এতটাই জটিল গাণিতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়, যে মনে করা হচ্ছিল এর দিন শেষ। ভিন্নধর্মী হিসেবের ফলে পাঁচ পাঁচটি স্ট্রিং থিয়োরি দেখা দেয়। এস ও (৩২) টাইপ ১, টাইপ ২ এ, টাইপ ২ বি, ই এইট X ই এইট হেটেরটিক এবং এস ও (৩২) হেটেরটিক। এতগুলির মধ্যে ঠিক কে আর ভুলই বা কে? এই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ বাতলান যাঁরা তাঁদের অন্যতম বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী অশোক সেন। তিনি মূলত কাজ করেছেন ডুয়ালিটি বা দ্বৈত সত্ত্বা নীতি নিয়ে। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, ধরা যাক দুটি তত্ত্ব, যারা আপাতভাবে ভিন্ন হলেও একই রকমের ঘটনা বা কণার অস্তিত্বের পূর্বাভাষ দিতে পারে, তাদের ডুয়াল থিয়োরি নামে অভিহিত করা যায়।
চিত্র ৭: অশোক সেন
এই ভাবনা পদার্থবিদ্যার চিরাচরিত প্রচলিত একটি ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ স্বরূপ, যেখানে সমগ্র কিছুকে খণ্ডিত রূপে দেখা হয়ে এসেছে। যেভাবে এসেছে যৌগিক কণা তথা মৌলিক কণার ধারণা। যেখানে উপাদান মৌলিক কণাগুলির ধর্মের সমষ্টিই যৌগিক কণাটির চরিত্র নির্ধারণ করে। ডুয়াল থিয়োরি বলছে এতে কোনও একটি কণার বা ঘটনার প্রতি পক্ষপাতিত্ব চলে আসে, যা ঠিক নয়। ডুয়ালিটির পূর্বাভাষ কীভাবে করা সম্ভব ডঃ সেনই একটি গবেষণামূলক নিবন্ধে তার একটা রূপরেখা দেন । সেখানে উল্লিখিত একটি প্যাটার্ন বা বিন্যাস বর্তমানে স্ট্রিং থিয়োরি নিয়ে কাজ করা গবেষকদের কাছে এতটাই জরুরি, যে তার নামকরণ করা হয়েছে ‘সেন প্যাটার্ন’। উপরে বর্ণিত পাঁচটি স্ট্রিং থিয়োরিও কিন্তু ডুয়াল। মানে এর মধ্যে কোনও একটা তত্ত্ব অনুযায়ী কোনও একটি বিশেষ কণা মৌলিক হলেও অন্য একটি অনুযায়ী তা যৌগিক হতে পারে! এর মধ্যেই হয়তো প্রকৃতির একীভবনের কোনও সঙ্কেত নিহিত আছে!
চিত্র ৮: কণা পদার্থবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেল
মাত্রা কি কম পড়িয়াছে?
‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ হল কণা পদার্থবিদ্যার দুনিয়ায় অন্যতম সার্থক তত্ত্ব। আণুবীক্ষণিক জগতের অনেক রহস্যের ব্যাখ্যাই এর সাহায্যে পাওয়া যায়। তিনটি বল আর ১৮টি কণার সমন্বয়ে গঠিত এই মডেল। ছ’রকম ভারী কোয়ার্ক কণা, ছ’রকম হাল্কা লেপ্টন কণা এবং আরও ছ’রকমের বোসন কণার কথা বলা হয়েছে এখানে। শেষের ছটির মধ্যে একটি আবার বহুলচর্চিত হিগস বোসন কণা যাকে গণমাধ্যমের কল্যাণে ঈশ্বর কণা নামেও আমরা অনেকেই চিনি। তার অনুসন্ধানও এখনও অব্যাহত। সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনে যার বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়।
কিন্তু এত কার্যকরী মডেল হওয়া সত্ত্বেও একে নিয়ে কিছু খটকা রয়েই যায়। মহাকর্ষ বল তো এই মডেলের বাইরেই অবস্থিত, তা ছাড়াও সম্প্রতি কয়েকটি পরীক্ষায় এই তত্ত্বের কিছু অসম্পূর্ণতাও দেখা গেছে। তাতেই আরও একবার উঠে এসেছে সেই ‘সুপারসিমেট্রি’ বা অতিসাম্যতার তত্ত্ব, যেখানে মহাবিশ্বের সমস্ত বলকে একীভূত করার কথা বলা হয়। সেক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড মডেলও অতিসাম্যতারই একটা অংশে পরিণত হবে। মহাকর্ষের ব্যখ্যা দিতে গিয়ে আইনস্টাইন তিনটে স্থান আর একটা সময়ের মাত্রাকে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু বাকি বলগুলিকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে আমাদের তো আরও মাত্রা প্রয়োজন। যেহেতু মহাকর্ষের তত্ত্ব অন্যান্য বলের ক্ষেত্রে সেভাবে প্রযোজ্য নয়। তাহলে আপাতভাবে পাওয়া তিনটে স্থানের আর একটা সময়ের মাত্রাই যথেষ্ট নয়! স্ট্রিং থিয়োরিতে অঙ্ক কষে ১১টা অবধি মাত্রা পাওয়া গেছে। ১০টি স্থানের আর একটা সময়ের। কিন্তু আদৌ বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব আছে কি? ছোট বা অস্বাভাবিক বড় হওয়ার জন্য হয়তো তারা চোখে পড়ে না, কিন্তু তারা তো থাকতেও পারে। যেমন একটা সরু তারকে আপাতভাবে এক মাত্রিক মনে হলেও একটা পিঁপড়ে অনায়াসে তাকে ঘিরে ঘুরতে পারে, যা তার কাছে ত্রিমাত্রিক! তাহলে হতেই তো পারে আমাদের চারপাশে এমন আরও মাত্রা বর্তমান, যাদের আপাতদৃষ্টিতে, অন্তত আমাদের সীমিত ধ্যানধারণার পরিপ্রেক্ষিতে অনুভব করা সম্ভব নয়! স্ট্রিং থিয়োরিতে বর্ণিত এইসব মাত্রার অধিকাংশই নানারকম বক্রতা সম্বলিত স্থান বিশেষ। সোজাসাপটা দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতার ধারণা থেকে তারা অনেকটাই ভিন্ন।
চিত্র ৯: স্ট্রিং থিয়োরিতে বর্ণিত বিভিন্ন বক্রতা বিশিষ্ট স্থান মাত্রার কল্পিত চিত্র
সব পেয়েছির দেশে
বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান বক্তা মিশিও কাকু আর এক ধাপ এগিয়ে স্ট্রিং থিয়োরিকে মহাবিশ্বের সবচেয়ে গূঢ় দুটি রহস্যের উদ্ঘাটক হিসেবে বর্ণনা করেছেন । বিশ্ব সৃষ্টির শুরুয়াত মনে করা হয় বিগ ব্যাং-কে। সময়ের সূত্রপাত ও তখনই। এর আগে কী ছিল? আর পরম শক্তিশালী ব্ল্যাকহোলের গভীরেই বা কী হয়, তার হদিশ দিতে পারে এই ‘সব পেয়েছির তত্ত্ব’!
চিত্র ১০: মিশিও কাকু
তিনি মাল্টিভার্স তত্ত্ব বা বহুবিশ্বের তত্ত্বের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করছেন। হতে পারে ক্রমবর্ধমান বুদবুদের তুল্য আমাদের এই বিশ্ব আসলে সেই সৃষ্টির আদিতে, বিগ ব্যাং এর সময়ে আরও বড় কোন বুদবুদের থেকে ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল। অন্য বুদবুদটিও রয়েছে এই বিশ্বের সীমানার বাইরেই কোথাও। আমাদের এই বিশ্ব যেদিন ক্রমাগত ঠাণ্ডা হতে হতে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে, তখন বক্রতা বিশিষ্ট স্থান-সময়ের সুযোগ নিয়ে আমরা হয়তো কোনও এক ‘ওয়ার্ম হোলের’ সুড়ঙ্গপথে পাড়ি দিতে পারি অন্য উষ্ণতর বিশ্বে। এসব যদি নিছক কল্পবিজ্ঞান কাহিনি মনে হয়, তাহলে বলতে হবে, স্ট্রিং থিয়োরির গাণিতিক সূত্র বা বিশ্লেষণ কিন্তু তা বলছে না! আর কে না জানে, এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রায় সমস্ত উন্নত প্রযুক্তি, যন্ত্র তথা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পিছনে অবশ্যই ছিল জটিল গাণিতিক তত্ত্ব! এখানেই রয়ে যাচ্ছে স্ট্রিং থিয়োরির হাত ধরে আমাদের নিয়তি বদলের একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা। নতুন দুনিয়ার হাতছানি। যেদিন এই সব সূত্র আর তত্ত্বকে খাতা কলম আর কম্পিউটার স্ক্রিন ছাড়িয়ে উন্নততর প্রযুক্তি আর বাস্তবসম্মত প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক প্রয়োগের আওতায় এনে ফেলতে পারব, সেদিন নিঃসন্দেহে বলতে পারব স্ট্রিং থিয়োরিই আমাদের সব পেয়েছির দেশে যাওয়ার রাস্তা!